বনমালী, আমি এই জনমেই হব রাধা
কলকাতা: ২৫ বছরের তাজা প্রাণ। স্বপ্ন দেখতেন শখে-আহ্লাদে, ভালোবাসার আশ্রয়ে জীবন যাপনের। কিন্তু, সে যে হওয়ার নয়। তাঁর মস্ত অপরাধ, তিনি শরীরে পুরুষ হয়েও অন্তরে নারী! তাই তিনি ভালোবাসেন নারী নয়, পুরুষকে। সেই অপরাধেই নিজের পরিবারের কাছ থেকে অনার কিলিং (Honour Killing) বা সম্মান হত্যার হুমকি পেলেন নবপল্লি বারাসাতের শুভঙ্কর রায় (Subhankar Roy)।ভাবতে লজ্জা করে, ২০১৪ থেকে লড়াই শুরুর পর ২০১৮-য় আইনি স্বীকৃতি। তারপরেও ঘুরে গেছে একটা বছর। তবু সমলিঙ্গে বিবাহ আজও ব্রাত্য সমাজে। তাও আবার শিক্ষিত-সংস্কৃতিমনস্ক খোদ শহর কলকাতায়।
নিজেকে বাঁচাতে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে চিঠিতে শুভঙ্করের স্বীকারোক্তি, ছোট থেকেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কোথাও তিনি সবার থেকে আলাদা। শরীর পুরুষালি হলেও, মনে মানবী তিনি। এই যন্ত্রণা একটা সময় তাঁকেও বিব্রত করেছে। কিন্তু, প্রকৃতির খেয়ালের বাইরে বেরোবেন কী করে? তাই শেষমেশ তাঁকে আত্মসমর্পণ করতেই হয় নিজের কাছে। পরিবারের কাছে। চলতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বাড়িতে জানাতেই রে-রে করে তাঁর ওপর চড়াও হন বাবা-কাকা-কাকীমা-মাসি-প্রতিবেশি। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ এবং শারীরিক অত্যাচার চালাতে থাকেন সবাই। জোর করে বিয়ে দিতে চেষ্টা করেন শুভঙ্করের। মানসিক অত্যাচার চলছে শুভঙ্করের প্রেমিকের ওপরেও। বাবা গোপাল রায় স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছের জন। সেই কাউন্সিলর আবার কাছের মানুষ সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারের। সেই জোরে স্থানীয় কাউন্সিলরের উপস্থিতিতে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখানোর পাশাপাশি সম্মান হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে উভয়কেই।
যত দিন গড়িয়েছে ততই মাত্রা ছাড়িয়েছে শারীরিক-মানসিক নিগ্রহ। অবশেষে নিজেকে এবং নিজের ভালোবাসাকে বাঁচাতে আজন্ম বেড়ে ওঠা ঘর-পরিবার ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন শুভঙ্কর। শরীরে-মনে দগদগে ক্ষত নিয়ে এই মুহূর্তে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন ট্রান্সজেন্ডার আন্দোলনের নেত্রী রঞ্জিতা সিংহের কাছে। ফোনে রঞ্জিতা বা গোপালবাবু কাউকেই পাওয়া যায়নি। তবে সাড়া দিয়েছেন শুভঙ্কর। আহত-বিমর্ষ গলায় জানিয়েছেন, 'আমি তৃতীয় লিঙ্গ নই। সমকামী। এটা ভয়ানক দোষের? আমায় মারধরের পাশাপাশি অকথ্য অত্যাচার চালানো হচ্ছে আমার ভালোবাসার মানুষের ওপরেও। তবে এত খারাপের মধ্যেও ভালো খবর, তিনি এখনও পাশেই আছেন আমার। সারা জীবন থাকারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।'
ভবিষ্যত নিয়ে কী ভাবছেন তাঁরা? এভাবেই কি লড়াই করতে করতে কেটে যাবে পুরো জীবন? এত অত্যাচারের পরেও ইতিবাচক মন নিয়ে বাঁচছেন শুভঙ্কর। আশা, অশিক্ষার মেঘ সরে শিক্ষার আলো একদিন জ্বলবেই। সেদিন তিনি এবং তাঁর মতো 'রাধা'র দল নিঃসংকোচে ভালোবাসতে পারবেন বনমালীকে।
আপাতত শুভঙ্কর আর তাঁর প্রেমিকের লক্ষ্য, পায়ের তলার মাটি শক্ত করা। অর্থনৈতিক দিক থেকে আরও শক্তিশালী হওয়া। যাতে আগামী দিনগুলো অনিশ্চয়তায় না কাটাতে হয়। তবে সেখানেও বিপদ ওঁত পেতে আছে। শুভঙ্করের কথায়, অফিস এতদিন কিছুই জানত না তাঁর সম্বন্ধে। সোমবার সন্ধেয় তাঁরা একটি প্রতিবাদ মঞ্চে লাইভ হয়েছেন। আশঙ্কা, কাল অফিস তাঁকে মানবে তো! যদিও তাঁর যুক্তি, লিঙ্গে তিনি যা-ই হোন, কাজে তিনি দক্ষ। এবং অফিসের উচিত কর্মীর দক্ষতা দেখা। লিঙ্গ নয়। কিন্তু, শুভঙ্করের এক পিসতুতো দাদা ওই বেসরকারি অফিসের অন্য একটি শাখার কর্মী। বাবার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানের এইচ.আর বিভাগের। ফলে, ঘর পোড়া গরুর মতোই সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাচ্ছেন তিনি। একই সঙ্গে প্রশ্ন, ২০১৪-র লড়াই কবে শেষ হবে?