This Article is From Jan 08, 2019

এক গাঙ্গেয় সন্ধ্যার বিষণ্ণ রূপকথা

শুরু হল সাংবাদিক ও লেখক বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্যের নতুন ব্লগ। আজকের বিষয়, গঙ্গার ধারের এক নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায় দুই মানুষ।

Advertisement
Featured Posts Written by

সাড়ে পাঁচটা বাজে। নভেম্বরের বিকেল সাড়ে পাঁচটা। এখনই সন্ধে। রাস্তার যে ল্যাম্পপোস্টটা জ্বলছে না, আর কখনওই জ্বলবে না, সেটি বেয়েই নেমে এসেছে অন্ধকার। অমন একটি ল্যাম্পপোস্টের গায়েই গতরাতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল বছর বাইশের এক যৌনকর্মী। নিলামে শেষমেশ তার যা দাম উঠেছিল, সেই দরে রবিবারের ভোরের কোলে মার্কেটে একটি মাঝারি সাইজের কাতলা হয়ে যাবে। ল্যাম্পপোস্টের গায়ে ডিকে লোধের বিজ্ঞাপনী পোস্টার। তার পাশে একটা সাদা কাগজে পেন দিয়ে আঁকাবাঁকা অক্ষরে 'অনন্ত+রুবি' লিখে কেউ আঠা দিয়ে সেঁটে দিয়ে গিয়েছে। এমন একটি ল্যাম্পপোস্টের দিকে তাকালে মনে হয়, তার এখন এই পোস্টারগুলো ছাড়া আর কেউ নেই। কিছু নেই। তবে একদিন কেউ ছিল। বহুক্ষণ ধরে তার জন্য ভাত বেড়ে বসে থাকতে থাকতে আঁচলের খুঁট দিয়ে মুখ মোছার মতো সত্যিই কেউ ছিল একদিন...

এমন একটি ল্যাম্পপোস্ট রয়েছে দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গার ঠিক পাশেই। একেবারে পাশেও যে রয়েছে, তা বলা চলে না। ল্যাম্পপোস্ট আর গঙ্গার মাঝখানে একটি বস্তি  রয়েছে। বস্তির একটি-দুটি ঘরে কয়েকদিন আগেও টালি ছিল। এখন সেখানে অ্যাসবেস্টস। শাঁখ বাজিয়ে দিল ওই ঘরগুলোর মধ্য থেকে কেউ কেউ। কে বাজাল, কে জানে! গঙ্গায় এখন ভাঁটা কাটিয়ে আবার জোয়ারের জল উঠে আসছে। শাঁখের শব্দ সেই জোয়ারের জল ধরে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ধাক্কা খেল বালিব্রিজে। কিছুটা চলে গেল নতুন স্কাইওয়াকটার দিকে। বহু উঁচুতে সেই স্কাইওয়াক। সেখান থেকে তাকিয়ে দেখলে নিচের মানুষগুলোকে দু'বছর আগের বাতিল হয়ে যাওয়া কোনও হাজার টাকার নোটের মতো তুচ্ছ মনে হয়।  স্কাইওয়াকে অনেকটা সেজেগুজে এসে উঠে দাঁড়িয়েছে বহু মানুষ। কেউ কেউ সেলফি তুলছে। কেউ মুড়ি আর বেগুনি খেতে ব্যস্ত। সঙ্গে প্রায় বেগুনির সাইজেরই একটি কাঁচালঙ্কা। একবার করে কামড় দিলেই চোখের সামনে অত বড় স্কাইওয়াকটা ঝালের চোটে একটু করে দুলে উঠছে। বালি ব্রিজের তলার বস্তির ধারেই গঙ্গা। কয়েকটা নৌকা বাঁধা আছে ঘাটে। নৌকার ওপর বসে মোবাইলে শাহরুখ খানের সিনেমার গান শুনছে কয়েকজন। সদ্য আসা জোয়ারের জলে দুলছে নৌকা। সদ্য আসা জোয়ারের জলে দুলছে ব্রিজ থেকে উথলে পড়ে যাওয়া স্ট্রিটল্যাম্পের আলো। ওই আলোর পাশ দিয়েই হেঁটে চলে গেল ওরা দুজন। ওদের গায়ে কোনও আলো নেই। আলোর ভেতর আঁধারের দুই চাকতিই হেঁটে চলে গেল যেন। 

ছবি সৌজন্যেঃ গুগল

ওরা ওদের দুজনের নামটা লিখে রাখার একটা জায়গা খুঁজছিল। যেমন আরও অনেকে নাম লিখে রাখে নিজেদের। বুম্বা+বিউটি, অরিন্দম+পারমিতা, মকবুল+নাহিদ...একটু কাঁপা কাঁপা হাতে কেউ কেউ লেখে সমীর+মমতাজ...কিন্তু ওদের নাম লেখা হচ্ছে না। কোথায় লিখবে বুঝতে পারছে না তাও। ওদের মাথার ওপর কখনও ব্রিজ। ওদের মাথার ওপর কখনও স্কাইওয়াক। কোনও একটা নতুন জায়গায় পৌঁছলেই নিজেদের নামটা লিখে রাখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু, হয় না। স্কাইওয়াকটা বড় সুন্দর। বড় এবং সুন্দর। ওখানে নাম লিখে দিলে বহুদিন পর্যন্ত থেকে যাবে৷ ওদের নামটির ওপর পড়ে থাকবে পাঁচশো কোটি বছর ধরে এই পৃথিবীতে প্রতিদিন নিয়মিত আসতে থাকা সূর্যের আলো। খুব অন্যমনস্ক কেউ কেউ হঠাৎ অনেকক্ষণ ধরে আলতো হাত রেখে দেব ওদের ওই নামটির ওপর। দীর্ঘদিনের কোনও ঝগড়া ওদের নামটির কাছে এসেই শেষ হয়ে যাবে কখনও কখনও। একটা-দুটো পাখিও এসে বসবে না কি? রথের দিন কোনও চিরকালের হেরে যাওয়া মানুষ ওদের এই দুটি নামকে একটা বড় পাঁপড়ও দেবে নিশ্চয়ই... 

আরও পড়ুনঃ মাঝেরহাট ব্রিজ, তুমি আমাদের বড় আপন ছিলে

Advertisement

যা ভাবা হয়, যেমনভাবে ভাবা হয়, তা তো কোনওদিনই ঘটে না। ঘটে অন্য কিছু। একেবারেই অন্যরকম কিছু। ওরাও তাই স্কাইওয়াকে নাম লিখতে পারেনি। গিয়েছিল বেশ কয়েকবার। কিন্তু যখনই একটা ভালো জায়গা দেখে লিখতে চেষ্টা করে তখনই এক কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী ছুটে আসে 'এই বাঞ্চোৎ' বলে। 

নিজেদের নামটি কোথাও লিখে রাখতে হবে, এমন কোথাও, যেখানে নামটি কোনওদিনও হারিয়ে যাবে না। ওরা ভেবেছিল স্কাইওয়াক। কিন্তু, যদি ভূমিকম্প হয়, তা তো ধ্বসে যেতে পারে। তখন? ওরা ভেবেছিল নৌকা। তারও তো সলিলসমাধির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ওরা ভেবেছিল কোনও এক মানুষের গায়েই লিখে রাখবে নিজেদের নাম। কিন্তু, সেই মানুষটি ছাই হয়ে যাওয়ার পর কী হবে? বা, মাটিতে মিশে যাওয়ার পর? নামটিকে কোন মাটিতে খুঁজে পাবে তারা? 

Advertisement

আরও পড়ুনঃ জঙ্গলমহলের বাপ ও রতনমোহন শর্মার বন্দিশ

ঘাটে বাঁধা নৌকায় চলা শাহরুখ খানের গানের পাশ দিয়ে হেঁটে আসছিল তারা। এই সময়টা এই জায়গাটা অন্ধকার। বস্তির মানুষগুলো বেশিরভাগই এখন আলো পড়লেই সেজেগুজে স্কাইওয়াক দেখতে চলে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে থাকছে সেখানে। এসক্যালেটর দিয়ে নামছে উঠছে। ওরা এখন ব্রিজের তলায়। ওদের পাশে ব্রিজের বড় বড় থাম। একেকটি থামের বয়স পঁচাত্তর বছরের বেশি। একটা বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, বেশ কয়েকটি দাঙ্গা ও পালাবদল পার করে এই থাম এখনও থিতু। এখানেই কি লিখে রাখবে তাহলে? কিন্তু এখানে তো অনেকেরই নাম লিখে রাখা। এই থামও তো কোনও না কোনওদিন ক্লিন্ন হয়ে পড়তে পারে। তখন?

Advertisement

ওদের পায়ের কাছেই গঙ্গা। জোয়ারের জল বাড়ছে ধীরে। একজন আরেকজনের কাঁধটিতে মাথা রাখে। পাঞ্জাবি পরা কাঁধ। গালে দাড়ি।  যে মাথা রেখেছিল কাঁধে, সে ফিসফিস করে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করে- তাহলে?

গালে দাড়ি পুরুষটি হাসল তখন। অনেক শতাব্দী বাদেই যেন অল্প হেসে ওঠে সে। সিগারেট ধরানোর ছিল তার। ধরাল না। তারপর বলল, একটাই উপায় আছে...

Advertisement

সন্ধে ছ'টা দশের পৃথিবী তারপর দেখতে পায়, তার কোলে যে গঙ্গা নদীটি দোল খাচ্ছে, তার জলে আঙুল ডুবিয়ে দুজন পুরুষ নিজেদের নাম লিখছে অতি যত্নে।

একজন লিখল- অরুণ।

Advertisement

আরেকজন তার পাশাপাশি লিখল- বরুণ।

জলের ভিতর নাম। যতদিন এই পৃথিবী, ততদিনই এই জল। এক ঢেউয়ের ভিতর আরেক ঢেউ মিশে দুটোই এক হয়ে যায়। জোয়ারের জলে দুটো নাম একে অপরের হাত ধরাধরি করেই যেন আপনমনে ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছিল তারপর পূর্বদিকে।

Advertisement