This Article is From Aug 16, 2018

স্বাধীনতার গান ও কলকাতা বাহাত্তর

কলকাতা বাহাত্তর, স্বাধীনতা দিবসের রাত ও এক মানুষের কাহিনী। লিখলেন বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য।

স্বাধীনতার গান ও কলকাতা বাহাত্তর

কলকাতার ভিতর দিয়ে চলে যাওয়া এক রাস্তার একটি বেদিতে বসে আছে সে। তার নাম এটুকুই।আর কিছু নয়। আর কেউ নেই। তার নাম 'সে'। কোনও পদবি নেই। পদবি একটি প্রাগৈতিহাসিক ফুসমন্তরের মতো ব্যাপার। এই রাস্তাটিতে পনেরোই অগস্টের এই রাত্রিতে এই সময় 'সে' ছাড়া আর তেমন কেউ নেই।  তেমন কেউ থাকে না। রাস্তাটির পোস্টাল অ্যাড্রেস কলকাতা-72।  কয়েকজন ঝালমুড়ি-ওয়ালা তাদের চাকালাগানো এতোলবেতোল গাড়িতে প্লাস্টিকের মগে পড়ে থাকা রেডিয়োয় মশলার তাপ নিয়ে বয়ে চলা সেমি-চটুল হিন্দি গান সঙ্গে করে রয়েছে কেবল। কয়েকজন রহস্যগুল্মের মতো রুগ্ন গাঁজাখোর আছে তাদের ক্রমাগত এপিঠ অথবা ওপিঠ উল্টে যাওয়ার রূপকথাসম অশ্লীলতা নিয়ে।ক'জন লুঙ্গি ও পায়জামা পরা অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ সুখনিদ্রা হয়ে পড়া চায়ের দোকানের সামনে ফুটপাথের আড্ডাকে ঘাড়ে করে বসেছে পিঠ,মাথা ও হাঁটু চুলকানি নিয়ে।আর যা আছে,তা হল ছোট ছোট জাতীয় পতাকার নেতিয়ে পড়া টুকরো, কুকুর, একটা-দুটো বা দুটো-একটা হর্ন বাজিয়ে চলে যাওয়া গাড়ি ও শ্রাবণ মাসের স্যাঁতসেঁতে হাবা আলোর হল্লাচিহ্ন। তারপর তো এক অপরিজ্ঞাত ক্ল্যাসিক অন্ধকার…

'সে' উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বেদি থেকে। ব্যর্থ হয়।আবার চেষ্টা করে।পারে না। তাই বসে থাকে বেদিতে। রাস্তাটি এতটাই ফাঁকা যে,  একটি গাড়িও আসে না।  যেন, এই রাস্তা দিয়ে কখনও কোনও গাড়ি যায়ইনি।  সেই আঁধারকোণে লুকিয়ে থাকা মুখ নিয়ে তারপর সে হঠাৎ দিতে শুরু করে ওই ফাঁকা ভিজে কলকাতা বাহাত্তরের স্বাধীনতার রাস্তাটির মাটিতে হামাগুড়ি। এটা পারছে। ভালোই পারছে। হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিটি কেমন জান্তব। নীল শাড়ি পরে আছে সে।হামাগুড়ি দেওয়ার সময় পেটের জায়গাটা খুলে গিয়েছে অনেকটা।তা কালো এবং পেলব। বাকি শরীরে থাক করে লেপে দেওয়া মাংস। দুটো হাতে ভর দিয়ে চলেছে সে। হাত দুটো অযথা রোমশ। তার এখন ছত্রিশ বছর কয়েক মাস বয়স।আর দুটো সপ্তাহ পেরোলেই অন্য বয়সে পড়বে। ছোটবেলায় এইভাবে হামাগুড়ি দিত তাদের বারাসতের বাড়িটিতে। সে আর সেজদি। বাকি দিদিরা কেউ তেমন পাত্তা দিত না। কেউই কথা বলত না সেভাবে। তার সেজদি তার মতোই বাড়িতে নিখাদ দুয়োরানি। বাঙালির সংস্কৃতিতেও। এমনকি, শরৎচন্দ্রও বড় বা মেজকে নিয়ে লিখলেও, তাকে নিয়ে কিছু লেখেননি। তবে, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় কিছুটা চেষ্টা করেছিল। সুচিত্রা সেনকে একবার একটি সিনেমায় প্রশ্ন করেছিল- 'এ'সব কি তুমি খুঁজে বেড়াচ্চ, সেজদি'?...তারপর কী বলেছিল, মনে নেই। হামাগুড়ি দিতে দিতে সে তার সেজদিকে মাঝে মাঝে ওই প্রশ্নটাই করত।  তাকে দেখতে অনেকটা তার সেজদির মতোই। মোটা। গায়ের রং চাপা। তবে চোখ দুটো আলাদা। সে নিজেও ঠিক আর পাঁচজনের মতো নয়। সংবিধান তাকে দিয়েছে এক সেলোফেন পেপারের মতো পাতলা ফিনফিনে পরিচয়। থার্ড সেক্স। সে যেন ঠিক মানুষ নয়। বরং, একটি সংখ্যা। বিল্লা নাম্বার সাতশো ছিয়াশি। মা খু চিহল ও পঞ্জম হস্তম। বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে অনেকদিন। যোগাযোগও নেই আর কারও সঙ্গে। তা, সেই সংখ্যা-মানব কলকাতার বিভিন্ন সংখ্যা লাগানো রাস্তাতেই ঘুরে বেড়ায়। এখন যেমন বাহাত্তরে। গতকাল ছিল বাষট্টিতে। আগামীকাল ছিয়াশি না চোদ্দতে যাবে, তা কেউ জানে না। তা, সেই ফাঁকা রাস্তার একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে হামাগুড়ি দিতে দিতে মফসসলের বড়ো উঠোনে বসে থাকা টিনের ছোট বাড়িটিকে সে বহু শতাব্দী বাদে দেখতে পেল আলো-আঁধারি রাস্তার অপরপ্রান্তে। ল্যাম্পপোস্ট থেকে ঠিকরে আসা আলোতে শ্রাবণের ভিজে পিচ রাস্তাটিও যেন হঠাৎই হাত আয়না হয়ে উঠেছে তার। একজন আত্মপ্রেমীর মতো নিজের মুখটিকে পর্যবেক্ষণ করার অছিলায় সে অনেকটা ফাঁকা রাস্তা একা একা হামাগুড়ি দিয়ে চলে। হামাগুড়ি দিতে দিতে ভাবে, সত্যিই কী অজস্র ও বিচিত্র জিনিসই না এই রাস্তায় রয়েছে! এই রাস্তা ধরে আর কতটা এইভাবে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে পারলে একেবারে মহাকাব্যের পাতায় পৌঁছে যাওয়া যাবে, ভাবল সে।রাস্তায় থাকা, প্রায় মৃতের মতো বেঁচে থাকা মানুষগুলো কেউই এইসব দেখছিল না।


যে যার নিজের মতো রয়েছে। যেমন ছিল। যেমন থাকে। মুখের পাউডার ঘামে গলে গিয়েছে। লিপস্টিক চেটে খেয়ে ফেলেছে অনেকটা। মিষ্টি-মিষ্টি খেতে। নেশার মতো। ছোটোবেলার এই অভ্যাস এখনও গেল না। লিপস্টিক পরলেই এক সময় খেয়ে ফেলে। আজও খেয়ে ফেলল। যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, হামাগুড়ি দিতে দিতেই খেয়ে ফেলল সে। এত ভালোলাগে! হঠাৎ, প্রায় আচমকা ঘাতকের মতো একটি কথা ছুটে এলো তার দিকে। কথাটা এবং তার ধরনটা ওর কাছে নতুন নয়। প্রায়শই আসে। এক প্রবল চুম্বকক্ষেত্র তার ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে যেন সহসা এই ফাঁকা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও এক অন্ধকার বাড়ির দরজা থেকে। বাড়িটি কোথায়, তা সে বুঝতে পারল না। কে বলল, তাও বুঝতে পারল না সে। হামাগুড়ি দিচ্ছে। সে তো বেড়াল নয়, তাই চলতে চলতে মাথাটা আর ঘোরাতে তুলতে ইচ্ছা করল না। তবে, কথাটা ওই একটা অন্ধকার থেকে এলো। অথবা, অন্ধকারই যেন নিজে থেকেই খানিকটা মস্করার ভঙ্গিতেই ছুঁড়ে দিয়েছে কথাটা তার দিকে। তা অনেকটা ওপর থেকে ঝপ করে এসে পড়ল তার মুখের কাছে-


"এই হিজড়ে,আসবি"?

এক বিশেষ ধরনের অ্যানিমিয়া ধরা পড়েছে তার। রক্ত কমে আসছে।  প্রথমবার রক্ত নিতে হল তাকে। রক্ত নেওয়ার পরও শরীরটা ঠিক জুতে নেই। তন্দ্রা আসে। ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে কিছুটা হেঁটে তারপর ট্যাক্সি নিয়ে সে চলে এসেছিল এই রাস্তায়। নীল শাড়ি পরে বসে ছিল বেদিতে। তাকে কথা বলতেই হয়।সেটা তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।  তবে আজ সে বলছে না। এরকম শব্দহীন হিজড়ে কেউ কখনও দেখেনি। এরকম হামাগুড়ি দেওয়া হিজড়েও কেউ দেখেনি কখনও। আজ তার মৌন নীল শাড়ি। মৌন হামাগুড়ি। মৌন মাংস। মৌন বাণিজ্য… রক্তের মধ্যে দিয়ে মানুষ মানুষের কাছে চলে আসে। এই প্রথম তার ভিতরেও ঢুকে গেল কেউ একজন। সেটা কার রক্ত, তা স্বাভাবিকভাবেই সে জানে না। সেজদির হতে পারে।  তার দালাল বিশুর হতে পারে। এমনকি, কথাটা ভেবে একটু চমকেই উঠল যেন সে, এই ফাঁকা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও বাড়ির ওপর থেকে প্রস্তাবটুকু ছুড়ে দিল যে, এই রক্ত তো হতে পারে তারও। হামাগুড়ি দিয়ে চলেছিল সে এতক্ষণ। সেহামাগুড়ি থামাল না। শরীরটা দুর্বল। নীল শাড়িটা ইতিমধ্যেই ছিঁড়ে গিয়েছে কয়েকটি জায়গায়। হাঁটুও ছড়ে গিয়েছে বেশ খানিকটা। রক্ত বেরোচ্ছে কি? বুঝতে পারল না সে।কেবল ওই অন্ধকার বাড়িটির দিকে তাকিয়ে জবাব দিল- না!



শব্দটি থেমে যায় অতঃপর।

রাস্তাটি ফাঁকা রয়েছে এখনও। ঝালমুড়িওয়ালার রেডিও থেকে কলকাতা বাহাত্তরে স্বাধীনতার একটি হিন্দি গান বেজে উঠল। হামাগুড়ি দিতে দিতে এক শতাব্দী থেকে আরেক শতাব্দীর দিকে গড়িয়ে যাচ্ছিল পনেরোই অগস্টের শব্দহীন হিজড়েটি...

.

.

.