This Article is From Nov 04, 2019

‘তুমি গেছ... স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে’....

১৯২৫-এর ৪ নভেম্বর কিন্তু একথা বলেনি। যেদিন এই আগ্নেয়গিরি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল বাংলাদেশে।

‘তুমি গেছ... স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে’....

অযান্ত্রিক হয়েও তিনি আজীবন মেঘে ঢাকা তারা

কলকাতা:

মৃত্যু এসে বলল জাগো...

১৯৭৬-এর ৬ ফেব্রুয়ারি। হতাশা-অবসাদ-অবহেলা মাখা এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির আচমকা মৃত্যু। চলচ্চিত্র দুনিয়া দেখল এক স্পর্ধার অপমৃত্যু। ১৯২৫-এর ৪ নভেম্বর কিন্তু একথা বলেনি। যেদিন এই আগ্নেয়গিরি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল বাংলাদেশে। যেন বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের বিখ্যাত মানসিকতা---‘তোমরা আমায় দাবায়ে রাখতে পারবা না'র জীবন্ত নিদর্শন। এক মাথা এলোমেলো চুল, মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ছেঁড়া ময়লা পাঞ্জাবি, ক্ষয়াটে চেহারা আর সময়ে-অসময়ে মদের গ্লাসে চুমুক--- এই নিয়ে বানিয়ে গেছেন অযান্ত্রিক, মেঘে ঢাকা তারা, তিতাস একটি নদীর নাম, কোমল গান্ধার, সুবর্ণরেখা-র মতো কালজয়ী ছবি। অমিতব্য়য়ীর মতো নিজেকে খরচ করে না ফেললে আজ তাঁর ৯৪ হত (94th Birthday)। নিজেকে নিংড়ে ঋতুতে ঋতুতে ছবির যজ্ঞে আহূতি দিয়েছেন যিনি, ঋত্বিক-মৃণাল-সত্যজিৎ ট্রায়োর প্রথমজন, পরিচালক (Eminent Bengali Director) ঋত্বিক কুমার ঘটককে (Ritwik Ghatak) NDTV-র স্মরণ, ফিরে দেখা, তাঁর জন্মদিনে। গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করে।

তিনি গেছেন, স্পর্ধা গেছে...

কালীমূর্তি সেজে রোদে রোদে ঘুরে বেড়ানো  বহুরূপীটার সামনে ভয়ে কেঁপে উঠেছিল ছোট্ট মেয়েটার শরীর। লোকটা ওকে ভয় দেখাবে বলেই যে সামনে এসেছিল, তা নয়। ভয় দেখাবে কি, খাবারের জন্যে দুটো পয়সার লোভে দিন দিন সে যে তার মানুষের মতো চেহারাটাই ভুলে গেছে।

ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি--গানটা যে তার ছেলেকে হাততালি দিয়ে শিখিয়েছিল সেকি জানত, তাকেও একদিন ঢুকতে হবে নিষিদ্ধ পল্লীর অন্ধকার ঘরে! সেখানে সেই রাতে তার ঘরে এসে ঢোকে তারই নিজের দাদা, যে দাদা কত আতঙ্কিত দিন আর রাতের ভেতর দিয়ে বাঁচিয়ে এনেছিল তাকে! লোকটা নেশার ঘোরে বুঝতেও পারনি, কার ঘরে ঢুকেছে সে।

fti86juo

চিৎকার করেনি সীতা, নীতা চেয়েছিল বাঁচতে। কেরানি মেয়েটি সংসারের জাঁতাকলে পড়ে, সমস্ত দিন প্রচণ্ড পরিশ্রম করে পরিবারের মুখে অন্ন জোগাতে জোগাতে তিলে তিলে ক্ষয়েছে ক্ষয় রোগে। স্বার্থপর পরিবার ফিকরেও দেখেনি তার দিকে। 

যার মা নেই, ভাই নেই, বউ নেই, সংসার নেই---সে পাগলের মতো ভালোবেসেছিল জগদ্দলকে। যান নিয়ে চলতে গিয়েও অযান্ত্রিক বিমল তার সব ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছিল একমাত্র বাহনকে। সেই জগদ্দলও একদিন বিকল। এভাবেই পথভ্রান্ত সমাজ, দর্শক তাঁর ছবিতে অন্ধকার আর আলোর গল্প শুনেছে। এসবের সাক্ষী ছিলেন ঋত্বিক ঘটক।

ভাবো ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিশ কর...

মনুষ্যত্বের ভগ্নস্তূপের ওপর দাঁড়িয়েও হতাশায় ভেঙে পড়েননি তিনি। বরং গলা ছেড়ে গেয়েছেন, 'কেন চেয়ে আছ গো মা?' যতদিন কাজের মধ্যে ছিলেন ঝড়ের মতো ছিলেন। তাঁর ছবিতে ধর্ম-কর্ম-বাক্য-বিবাহ-পাপ-আকাঙ্খা-শাসন-তোষণ-স্বপ্ন-ঐতিহ্য-পূরণ-লোককথা-পাঁচালি আর ছিন্নমূল অস্তিত্বের রক্তাক্ত বেদনা। অনেকেই বলেন তিনি নাকি হতাশাবাদী। কথাটা বোধহয় ঠিক নয়। জীবনের অবক্ষয়ের পাশাপাশি উদযাপনকেও তিনি সমান মর্যাদার আসন দিয়েছেন ছবিতে, জীবনে। যদিও তাঁর বর্তমানে তাঁর মূল্যায়ন হয়নি। কারণ, তিনি ছিলেন যুগের থেকে অনেক অ-নে-ক এগিয়ে। তাই আজ তাঁর যে সম্মান-যশ-খ্যাতি, বেঁচে থাকতে কানাকড়িও তাম দেয়নি কেউ তাঁর কাজের, মানুষটির। তাই নিজের ঘটিবাটি বাঁধা দিয়ে, স্ত্রী-র গয়না বেচে একের পর এক ছবি বানাতে হয়েছিল। সেসময়ের নিরিখে কোনোটা বাণিজ্যিক ভাবে সফল, কোনোটা নয়।

okbs68lg

ব্রাহ্মণে চিত্রাইছে পিঁড়ি সোনার রং দিয়া...

বারেবারে পড়ে উঠতে গিয়ে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত ঋত্বিক একসময় চলে গেছেন চরম আত্মনিগ্রহের দিকে। সব ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চেয়েছেন আত্মনিগ্রহে। তৎকালীন বিদ্বদ্জনদের মতে, পরিমিতির অভাব ছিল তাঁর। অনেকেই বলতেন, অতিনাটকীয়তা, মাত্রাতিরিক্ত আবে, বেপরোয়া ভাব, সংযমের অভাব---তাঁকে শেষ করেছে। আবার এটাও তাঁরাই স্বীকার করেন, এই দোষ না থাকলে যে জীবনদৃষ্টা বা শিল্পী, কোনোটাই হওয়া যায় না!

জীবন যেদিন ছুটি দিয়েছিল ঋত্বিককে, সেদিন মাটির দুনিয়ায় দুখী ফাগুন মাস। গাছে গাছএ আমের মুকুল। আর দূর থেকে ভেসে আসছিল বাংলাদেশী গানের সুর----

আমের তলায় ঝামুরঝুমুর কলাতলায় বিয়া,

আইলেন গো সোন্দরীর জামাই মুটুক মাথায় দিয়া,

ব্রাহ্মণে চিত্রাইছে পিঁড়ি সোনা রং দিয়া।।

ছায়া: ঋত্বিক কুমার ঘটক, ব্রাহ্মণে চিত্রাইছে পিঁড়ি

.