কলকাতা: বোধিসত্ত্ব: লেখকজীবনের ৬০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। এত পুরস্কার, সম্মান, জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। এত কিছু পেরিয়ে এই বয়সে এসে ঠিক কীসের তাগিদে লেখার টেবিলের কাছে ফিরে যান?
শীর্ষেন্দু: (হাসি) ফিরে যাই লেখার তাগিদেই। এছাড়া আর অন্য কোনও তাগিদ নেই। অনেক অল্পবয়স থেকেই বুঝেছিলাম, যদি কিছু করতে পারি, তবে এই বাংলা ভাষায় লিখেই হয়তো তা পারব। আর অন্য কিছু তো আমি সত্যিই পারি না তেমন। এই যে পুরস্কার, জনপ্রিয়তা, সম্মান ইত্যাদি বলছ, এগুলো কিন্তু লেখার টেবিলে যাওয়ার পর আর মনে থাকে না। তখন কেবল থাকে লেখক এবং তাঁর লেখা।
নতুন কিছু বলার তাগিদ…
সেটা তো অবশ্যই থাকতে হবে। নইলে লেখা হবে কী করে! তবে, একটা সময় পর তো অনেক লেখাই খুব ফরমায়েশি হয়ে যায়। সেই সত্যটাও অস্বীকার করা যায় না। তদসত্ত্বেও, এই কথাটি বলব যে, নতুন কিছু বলার তাগিদ না থাকলে সাহিত্য কখনওই প্রকৃত অর্থে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে না। নতুন কিছু বলার অথবা নতুনভাবে কিছু বলার তাগিদ, দুটোই সমান জরুরি।
একটি গল্প বা উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিষয় কতটা জরুরি? এখন যেটাকে ‘কনটেন্ট' বলেও ডাকা হয়। একটা একেবারে ফ্ল্যাট বিষয়কে অন্যভাবে দেখা নাকি একটা ‘অন্যরকম' বিষয়কে প্রথাগতভাবে উপস্থাপিত করা, নাকি এই দুটোর কোনওটাই নয়, লেখক হিসাবে আপনাকে এই তিনটির মধ্যে একটি পছন্দ করতে বললে, কোনটি করবেন?
প্রশ্নটি জরুরি। আমি বলছি তোমায় একটা কথা। বিষয় নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার যে কথা শোনা যায়, তা নিয়ে আমার কিছু বক্তব্য আছে। যে বিষয়গুলির দিকে তুমি ইঙ্গিত করছ বা আমি করছি বা অন্য কোনও লেখক করছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিন্তু তা একেবারে ‘নতুন' বা ‘ইউটোপিক', এমন কিন্তু নয়। বিষয় আমাদের চারপাশেই বিচরণ করে। করে থাকে। মূল বিষয়টা হল, লেখকের মনন ও মেধা। যা নিয়ে তিনি ওই বিচরণ করা বিষয়গুলির মধ্যে কোনও একটির কাছে গিয়ে উপস্থিত হবেন। অর্থাৎ, একটি বিষয়ের সঙ্গে লেখকের কী ইন্টারপ্রিটেশন, তা এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবন এবং তাদের সেই জীবনটির মধ্যে থেকে উঠে আসা নৈরাশ্য, ক্লীণ্ণতা, প্রশান্তি- এই সব কিছু নিয়েই এক সময় লেখা হয়েছে বাংলা ভাষায় বহু গল্প। অথচ, প্রত্যেকটি তার নিজস্বতায় ভরপুর।
আমি সেই কথাটাই বলছি। একটি মানুষ সংসার করছেন, অফিসে যাচ্ছেন, অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসছেন- আপাতদৃষ্টিতে এটা খুব সাধারণ একটা ব্যাপার। কিন্তু, একজন লেখক যখন তাঁর মেধা ও ভাবনা নিয়ে ওই সাধারণ ব্যাপারটির কাছেই পৌঁছচ্ছেন, তখনই সমস্তটার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসছে। তা যেন, আর ঠিক আগের মতো রইল না।
আপনি আপনার লেখকজীবনের একদম শুরুর থেকেই ভাষা নিয়ে বহু পরীক্ষা করেছিলেন। বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যে বহু সাহিত্যিকই ভাষা নিয়ে বিভিন্ন সময় উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। তবে, কারও কারও ক্ষেত্রে দেখা যায়, কাহিনিতে ভাষা যেন মেঘের মতো এসে বিষয়ের নিজস্ব আলোটিকে ঢেকে দিল। এই ব্যাপারটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
খুব ভালো প্রশ্ন এটা। ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি উপন্যাস তো অনেক পড়ে লিখেছি। সেটা সাগরদা, শ্রদ্ধেয় সাগরময় ঘোষের নির্দেশে। তার আগে বহু বছর কেবল ছোটগল্পই লিখতাম। তখন ভাষা নিয়ে অনেককিছু করার কথা ভেবেছি। উপন্যাস লেখার সময়েও ভাষা নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষানীরিক্ষা আমি করেছি। ভাষা হল কাহিনি, এক্ষেত্রে গল্প বা উপন্যাসের প্রাণ। তা না থাকলে কাহিনির গঠনটি ঠিকভাবে ফুটে উঠবে না। কিন্তু, একটি গল্প মানে কেবল ভাষাই নয়। গল্পের বিষয়, সেই বিষয়টির চলন, গল্পের নিজস্ব দর্শন- সবই তাতে থাকবে। আমাদের সমসাময়িকদের মধ্যে ভাষা নিয়ে প্রচুর পরীক্ষানীরিক্ষা করেছিল সন্দীপন। কিন্তু, ওই ভাষাটাকে বাদ দিয়ে দিলে মনে হয় গল্পগুলো খুবই মামুলি। তেমন কিছুই নেই।
পুরনো বন্ধু পুরনো আড্ডা এগুলোর কথা মনে পড়ে? ওই সময়টাকে মিস করেন?
একেবারে মিস করি না, তা বলব না। তবে, আমি সামনের দিকে তাকাতেই বেশি আগ্রহী। বিশ্বাস করি, কালের নিয়মে সবই এক সময় মুছে যায়। তবে, কিছু বন্ধুত্ব কিছু সম্পর্ক ঠিকই থেকে যায়। আমাদের মধ্যে এত বন্ধুত্ব ছিল। তাতে কোনও বৈরিতা ছিল না। সুনীল একটা ভালো লেখা লিখলে, আমারও ভালোলাগত। শ্যামল বা বরেনের কোনও ছোটগল্প পড়ে চমকে উঠলে মনে হতো ওদের এক্ষুনি কথাটা জানাই। বন্ধুরা নেই, কিন্তু, অনুভব করি, বন্ধুত্ব ঠিকই রয়ে গিয়েছে।
অথচ, আপনি তো কখনও আপনার অনেক লেখক ও কবিবন্ধুদের মতো ‘মধ্যরাতের কলকাতা শাসন' করেননি, মদ্যপানও করেননি, তাহলে এত অপূর্ব বন্ধুত্বটি হল কী করে?
না। তা আমি করিনি। আমি মদও খেতাম না। তবে, আমি ওদের বহু আড্ডার শরিক। বহু আনন্দের শরিক। মদ খেতাম না বলে ওরা কিন্তু কখনও আমাকে ‘আউটসাইডার' ভাবেনি। মদ খেয়ে তো অনেকসময় স্থিরতা থাকে না। তখন কিছু গোলমাল হয়ে যায়। এমন ঘটনারও বহুবার সাক্ষী হয়েছি আমি। একবার শিলং-এ বেড়াতে গিয়েছি। সুনীল আর শক্তিও ছিল। সে দিন ওদের মদ খেয়ে হঠাৎ কী যে হল! দুজনেই আমার প্রবল প্রশ্বস্তি আরম্ভ করে দিল। “আপনার মতো ভালো লেখক কেউ নেই”- এই ধরনের কথাবার্তা। আমি তো প্রবল অস্বস্তিতে পড়লাম। সারাক্ষণ এই বলে গেল দুজনে! কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না ওদের!
তারপর?
তারপর তো ঘুমিয়ে পড়ল।
নতুন লেখকদের লেখা পড়েন আপনি?
এখন আর পড়ার সময় বিশেষ পাই না। নিজের লেখা থাকে, তারপর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে হয়, বাকি সময়টা আমার নাতনির সঙ্গে কাটাতেই খুব ভালোলাগে। তবে, অনেকেই ভালো লেখেন, সেই খবর পাই। কারও কারও লেখা পড়ে দেখেছি। বেশ ভালোই লিখছেন তাঁরা। পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছেন।
প্রথম উপন্যাস 'ঘুণপোকা'-র শ্যাম আপনি নিজেই, এমন কথা একাধিকবার বলেছেন। ৮০ পেরিয়ে যাওয়া শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের নিজের মধ্যে এখন কতটুকু 'শ্যাম' রয়েছে?
বয়স যতই বাড়ুক, শ্যাম আমাকে ছেড়ে যায়নি কখনও। এমনটাই বিশ্বাস করি। শ্যাম ঠিকই রয়ে গিয়েছে আমার মধ্যে কোথাও না কোথাও।
এখন ডিজিটাল মিডিয়া আসার পর লেখা প্রকাশের যে চিরকালীন ব্যাপারটা, তা তো একদমই মুছে গিয়েছে। ফেসবুকের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটেও বহু মানুষ লেখেন, তা মুহূর্তে তাঁদের টাইমলাইনে পোস্ট হয়ে যায়। রীতিমত সাহিত্যচর্চার একটি কেন্দ্রই হয়ে উঠেছে তা। আপনি তো কখনও ডিজিটাল মিডিয়ায় লেখেননি। দীর্ঘ ৬০ বছরের লেখক জীবনের পর এই নতুন মিডিয়ামটিকে কীভাবে দেখেন?
আমি ফেসবুকে নেই। তবে, ফেসবুকের সাহিত্যচর্চার ব্যাপারে অবগত। আমি পড়ে দেখেছি অনেক লেখা। বেশ ভালো লেখা। আমার পুরো ব্যাপারটি ভালোলেগেছে। মাধ্যমটির বদল হয়েছে, এটা যেমন ঠিক, তেমন এই কথাটিও ঠিক যে, কেউ যদি ভালো লেখা লেখেন, তবে তা যেখানেই প্রকাশ পাক না কেন, তা সফল হবে। আর এত মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এত কম সময়ের মধ্যে এই লেখাগুলো, তা কি কম কথা! আমি সবসময়ই সমর্থন জানাই। আরেকটা কথা বলি, আমি কিন্তু ডিজিটাল মিডিয়ায় না থাকলেও, নিজে এখন লেখালেখি করি ট্যাবে। এতে অনেক ভালো হয়েছে। অনেক সুবিধা হয়েছে।
আপনি নিজস্ব ধর্মোচ্চারণের ব্যাপারে কখনওই লুকোছাপা করেননি। ধর্মবিশ্বাস নিয়েও আপনার নিজস্ব মতামত রয়েছে। এই মুহূর্তে দেশজুড়ে ধর্মকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাগুলি ঘটছে, তাকে আপনি কী চোখে দেখেন?
আমি এইভাবে ধর্মকে দেখিনি কখনও। ধর্মে আমি বিশ্বাসী। কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে যদি কোনও অশান্তি হয়, তাতে আমার সম্পূর্ণ বিরোধিতা রয়েছে। কোনও ধর্মই কখনও অশান্তির কথা বলে না।