পশ্চিম সিকিমের অপূর্ব সুন্দর গ্রাম ছায়াতাল
হাইলাইটস
- ছায়াতালের জলে ধরা দেয় তুষার শৃঙ্গের ছায়া
- শীতে সারাক্ষণ দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাব্রুকে
- পশ্চিম সিকিমের অধরা ডেস্টিনেশন ছায়াতাল
শীতটা কলকাতায় ততদিনে বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। জানুয়ারি মাস বলে কথা। এমন একটা ছুটি ছুটি ভাব সেই ডিসেম্বর থেকেই জাঁকিয়ে বসে। কিন্তু ওই এক বাধা, অফিস। তাকে বুঝিয়ে ছুটি নিয়ে বেড়াতে যাওয়াটাও বেশ ঝক্কির। তাও আবার এই দুম করে। কিন্তু বেড়ানো প্রেমে কোনও বাধাই বাধা নয়। আমাদের দলটাও খাসা। ‘‘পাহাড় যাবি?'' প্রশ্নটা একবার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছেড়ে দিলেই হল। রাত জেগে প্ল্যান শুরু হয়ে যাবে। ছুটি পেলাম কী পেলাম না সে সব পরে দেখা যাবে। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে মনের ইচ্ছেটা জানিয়েই দিলাম। আর ব্যস... উঠল বাই তো কটক যাই। তবে আমরা পৌঁছে গেলাম পশ্চিম সিকিমের অপূর্ব সুন্দর গ্রাম ছায়াতালে।
যেখানে বরফ ঢাকা হিমালয়ের ছায়া এসে পড়বে আপনার গায়ে। তার চোখে চোখ রেখে প্রতিদিন সূর্যকে উঠতে দেখা যাবে। ডুববে যখন তখন আকাশের রঙ নীল থেকে লাল হয়ে যাবে। ছোট্ট ছোট্ট ছেলে-মেয়েরা শীতে ঠকঠকানির মধ্যেই কিচিরমিচির করতে করতে স্কুলে ছুটবে পাহাড়, পর্বত ডিঙিয়ে। এমনই জায়গা ছায়াতাল। ছায়া লেক থেকেই এই নাম। তাল মানে লেক। ছায়াতাল নিজগুনেই অসাধারণ।
এমনই এক জানুয়ারির রাতে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দার্জিলিং মেলে চেপে বসেছিলাম আমরা ছ'জন। পরদিন সকালেই পৌঁছে গেলাম নিউ জলপাইগুড়িতে। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে ‘চলো লেটস গো' বলে যাত্রা শুরু। পশ্চিম সিকিমের রাস্তাঘাট কিছু কিছু জায়গায় বেশ খারাপ। জোরথাং, সোরেং, কালুক পেরিয়ে পৌঁছতে তাই দুপুর গড়িয়ে গেল। মাঝে রাস্তায় পাহাড়ের কোলে ঝুলে থাকা ছোট্ট দোকানে লাঞ্চ সেরে নিয়েছিলাম। যখন ছ'হাজার ফিটের গন্তব্যে পৌঁছলাম তখন সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। গাড়ি থেকে নামতেই কনকনে ঠান্ডা রীতিমতো জবুথবু করে দিল।
বরামাঙ্গওয়ার ঝুল বারান্দায় মেঘের সঙ্গে খেলা করে চাঁদের আলো
আমাদের আগমনের অপেক্ষাতেই ছিলেন নেচার হিলটপ রিসর্টের মালিক। রাস্তা থেকে কিছুটা এদিক ওদিক চড়াই ভেঙে পৌঁছে গেলাম রিসর্টের ঘরে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েই দেখলাম কীভাবে বরফচূড়াকে লাল আভায় রাঙিয়ে অস্ত গেলেন সূর্যিমামা। ততক্ষণে গরম গরম চা সহযোগে চিকেন চাউমিন হাজির হয়ে গিয়েছে। পেটকেও তো শান্ত করতে হবে।
অন্ধকার নামতেই লেপের তলায় সেধিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। সেখানেই জমল আড্ডা। সঙ্গে পকোড়া সহযোগে কফি। পাহাড়ে রাত তাড়াতাড়ি হয়। তাই আটটা বাজতে না বাজতে ডিনারের ডাক পড়ল। লেপের তলা থেকে বেরিয়ে ডাইনিং হল পর্যন্ত যাওয়ার মতো অবস্থা কারও ছিল না। তাই সেখানেই বসে ডিনারও সেরে ফেললাম সকলে। শুতে যাওয়ার আগে রাতের অন্ধকারে আরও একবার ধরা দিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছে গোটা চরাচর।
‘ও বাউল আর একটা গান গাও'... শান্তির ঠিকানা শান্তিনিকেতনে
দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি কেটে গেল এক ঘুমে। ভোর হল নানা অজানা পাখির কলকাকলিতে। হাজির বেড টি। দার্জিলিং টি-এ চুমুক দিয়েই বেরিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলাম। আজকের গন্তব্য পেলিং। সিকিমের খুবই পরিচিত ট্যুরিস্ট স্পট। তবে আমাদের সময় কাটল সিকিমের ইতিহাস বুকে দাঁড়িয়ে থাকা রাজ্যের পুরনো রাজধানী রাবডানৎসেতে। সেখান থেকে পৌঁছে গেলাম সিংসোর ব্রিজ দেখতে। অনেকবার গিয়েও এই ব্রিজ দেখার চমকটা নষ্ট হয় না। যতবার দেখি ততবারই মনে হয় এত উচ্চতায় জঙ্গলঘেরা পাহাড়ের মধ্যে কী করে তৈরি হল ঝুলন্ত এই ব্রিজ?
সিংসোর ব্রিজের উচ্চতা ৩২৮ ফুট আর ৬৫৬ ফুট লম্বা। ব্রিজের উপর দিয়ে যখন গাড়ি যায় তখন পুরো ব্রিজটা দুলতে থাকে। ব্রিজের উপর থেকে পাথর ফেলে দেখবেন সেই পাথরটি নীচে পড়তে এক মিনিট সময় নেয়। এতটাই উচ্চতায় তৈরি হয়েছে এই ব্রিজ। এখানেই কেটে যায় অনেকটা সময়। সেখান থেকেই ফেরার পথ ধরি। পথে স্থানীয় থুকপায় নিজেকে কিছুটা গরম করে নেওয়ার চেষ্টা। কারণ তাপমাত্রা ক্রমশ মাইনাসের দিকে ধাবমান। রাতে চাইনিস দিয়ে ডিনার সেরে ঘুমের দেশে। পরদিন আসপাশে ঘুরে দেখার পরিকল্পনাকে সঙ্গে নিয়েই।
ছায়াতালের আশপাশে রয়েছে হি-বারমিওক, কালুকের মতো সুন্দর ট্যুরিস্ট স্পট। ঘুরে আসা যেতে পারে সেখান থেকেও। কিন্তু আমরা এ বার ছায়া লেক দেখে, লেকের পাশের জঙ্গলে ঘুরেই কাটিয়ে দিলাম। সেখান থেকেও ধরা দিল কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাব্রু।
ট্রেক করতে ভাললাগলে এখান থেকে চলে যাওয়া যেতে পারে ওখড়েতে। সেখান থেকে ট্রেক করে চলে যাওয়া যায় ভার্সেতে। রডোডেনড্রনের বাগানের মধ্যে দিয়ে ট্রেক করে ভার্সে পৌঁছলেও এক অদ্ভুত ভাললাগায় ডুবে যাবেন নিশ্চিত। তবে ফুল দেখতে হলে যেতে হবে এপ্রিল থেকে মে-র মধ্যে। ভার্সে ট্রেকের গল্প অন্য কোনও দিন বলব আবার। এখন মনের কোণায় জমুক ছায়াতাল বেড়ানোর স্বপ্ন।
Click for more
trending news