This Article is From Feb 12, 2019

কোরাস- চিরন্তন অন্ধকার থেকে আলোর খোঁজে এগিয়ে চলার সরস্বতী পুজো

আলোর খোঁজেই শুরু হয় লড়াই। শুরু হয় একে একে প্রতিটি বাচ্চাকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার লড়াই। প্রথমে অনেকেই আসতে চাইত না। ধীরে ধীরে আগ্রহীর সংখ্যা বাড়ল। ওরা অনেকে মিলে পড়তে এল।

Advertisement
অল ইন্ডিয়া
দক্ষিণেশ্বর:

দক্ষিণেশ্বর মন্দির সংলগ্ন অঞ্চল। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত সেখান দিয়ে। এই যাতায়াতগুলো থেকে উঠে আসা বহু ধুলোবালি গায়ে মেখে উদ্ধত যতিচিহ্নের মতোই বেঁচে থাকত ওরা। ওরা মানে- পূজা, শেফালি, ছবি, যাদব, সুদীপ ওরা। ওদের কারও বাবা দিনে ভ্যান চালায়। রাতে চোলাই খেয়ে পড়ে থাকে ভ্যাটের ধারে। কারও মা কাগজকুড়ুনি। বাবা কোথায় কবে হারিয়ে তা জানে না। কারও বাবা-মা দুজনেই দিনের বেশিরভাগ সময় ভিক্ষা করার পর রাতে বাজারের সবজির দোকানে ফেলে খোসা বাড়ি এনে তা সেদ্ধ করে ছেলেমেয়েদের খাওয়ায়। দক্ষিণেশ্বরে থেকেও যেন ওরা ঠিক ‘দক্ষিণেশ্বরীয়' নয়। ওরা থাকে ওধারে। দক্ষিণেশ্বরের বস্তিতে। যে বস্তির পাশে গঙ্গা। মাথার ওপর বালিব্রিজ। সেখান দিয়ে কখনও কখনও ট্রেন চলে যাওয়ার পর গমগম শব্দ হলে ওরা ওদিকে তাকাত। বহুদিন, বহু মাস, বহু বছর ধরে ওই এক লহমার তাকানোটুকুই ছিল ওদের একমাত্র ‘উপরের দিকে তাকানো'। বাকিটা অতি জটিল শ্যাওলা ও শ্যাওলা-সংলগ্ন শূন্যতার তেতো-সোঁদা গন্ধের মধ্যে নিজেদের প্রায় পিষতে পিষতে বেঁচে থাকা।

এমন একটি সময়েই এই সমস্ত বাচ্চাদের জীবনে এসেছিলেন এক দম্পতি। সুপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পল্লব বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপরই প্রতিষ্ঠা পায় ‘কোরাস' নামের সংগঠনটি। যাদের মূল কাজ ছিল প্রাথমিকভাবে, দক্ষিণেশ্বরের বস্তির ওই বাচ্চাগুলোকে ভালো করে খাওয়ানো। পরানো। এবং, পড়ানো। “আসলে ওদের তো কিছুই ছিল না। যে বস্তুগুলিকে আমরা দুচ্ছাই করে ফেলে দিই, তা দিয়েও ওরা তৃপ্তির বসতবাটি তৈরি করে ফেলতে পারে। ওরা খেতে পেত না। ওদের বাবা-মা'রা কখনওই ওদের পড়াশোনা শেখাতে পারেনি। কিন্তু, আমরা সেই ২০১৪ সালে শুরুর দিনগুলি থেকেই বুঝেছিলাম, যত কম সামর্থ্যই থাক আমাদের, এই বাচ্চাগুলোকে প্রকৃত শিক্ষাটা দেওয়ার জন্য লড়াই করে যাব আমরা। ওদের আলোর দরকার ছিল। অন্ধকারের মধ্যে থাকতে থাকতে আলো বলে যে কিছু রয়েছে, তা তো ভুলতেই বসেছিল ওরা”, বলছিলেন পল্লববাবু।

সেই আলোর খোঁজেই শুরু হয় লড়াই। শুরু হয় একে একে প্রতিটি বাচ্চাকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার লড়াই। প্রথমে অনেকেই আসতে চাইত না। ধীরে ধীরে আগ্রহীর সংখ্যা বাড়ল। ওরা অনেকে মিলে পড়তে এল। কেউ নিয়ে এল শ্লেট-পেনসিল, কেউ নিয়ে এল অনেকদিনের পুরনো খাতা ও ভাঙা পেন, কেউ হয়তো নিয়ে এল একটি ছেঁড়া ক্যালেন্ডারের পিছনের সাদা অংশটিই। ওটুকুই তার সম্বল। ওটার মধ্যেই সে লিখবে।

Advertisement

২০১৪ সালে শুরু হয়েছিল এই যাত্রা। ৫ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। ‘কোরাস-এর দক্ষিণেশ্বর সেন্টারে এই মুহূর্তে সদস্যের সংখ্যা ১৫০ জনের বেশি। এই বৃহৎ যাত্রাটিতে পল্লববাবুদের কাঁধে হাত রেখেছেন আরও বহু মানুষ। ‘কোরাস' আরেকটি সেন্টার খুলেছে বেলুড় স্টেশনে। শুরু হয়েছে স্টেশনের নেশাগ্রস্ত বাচ্চাদেরও মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার লড়াই। শুরু হয়েছে একটা সরস্বতী পুজোও। পুজো প্যান্ডেল থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা সবই মূলত ওদের। সেই সরস্বতী পুজো ধূমধাম করে হয়ে গেল ‘কোরাস'-এর দক্ষিণেশ্বর সেন্টারে। এই পুজো দেখতে এসেছিলেন বহু বিশিষ্ট মানুষও। ওদের 'উপরের দিকে তাকানো'টা এখন আর কেবল ট্রেনের গমগমে আওয়াজ শুনেই হয় না। এমন বহু উল্লসিত আলোর বিস্তারের মুহূর্ত এখন ঘনঘনই তৈরি হয়, যা ওদের উপরের দিকে তাকাতে বাধ্য করে, যেন ওভাবেই তাকিয়ে থাকবে বাকি জীবনটা...

সেন্টারের পাশেই গঙ্গা। তার পাশে বহু গাছ। বায়ু বহে শনশন। পাতারা কাঁপে। তার ভিতর দিয়েই ওরা পুজোর মন্ত্র পড়তে থাকে মগ্নভাবে- সরস্বতী মহাভাগে, বিদ্যে কমললোচনে…     

Advertisement
Advertisement