নাই মা আমার পারের কড়ি, দে মা আমায় পার করে
কলকাতা: ৫৩ বছর নেই। তবু কালীপুজোর (Diwali 2019) দিন তিনি ভীষণভাবে জীবন্ত। কীভাবে? বাংলা ছবির গায়ক হিসেবে জীবন শুরু করেও কেন চলে এলেন শ্যামাসঙ্গীতের (Shyama Sangeet Singer) দুনিয়ায়? মাঝেমধ্যেই শ্মশানে যেতেন কিসের খোঁজে? তাঁর জীবনেও ঘটেছে বহু অলৌকিক ঘটনা। তবু দেবী কালীকার দেখা পাননি কোন ভুলে? মাত্র ৩৬ বছর বয়সে কী কারণে আত্মহত্যা করেছিলেন 'ঘোরতর সংসারী' পান্নালাল ভট্টাচার্য ( Pannalal Bhattacharya)? স্মৃতিকথা উপুড় করলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ছেলে এবং পান্নালাল ভট্টাচার্যের ভাইপো দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। মুঠোফোনে নির্বাক শ্রোতা উপালি মুখোপাধ্যায়
চাই না মাগো রাজা হতে....
রেকর্ড বা রেডিওয় গান শোনা নয়, অনলাইনে সিঙ্গলস শোনার যুগ। রেকর্ড, এইচএমভি সংস্থা, রেডিও কী বস্তু? এই প্রজন্মের হাতেগোণা ক-জন হয়ত জানে। তার মধ্যেও অত্যাশ্চর্য ঘটনা, কালীপুজো এলেই ভীষণ ভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় শ্যামাসঙ্গীত শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য। যিনি ৫৩ বছর আগে অতীত! এই শিল্পীকে কেন যেন সযত্নে এড়িয়ে চলে মহাকালও। যুগের পর যুগ কেটেছে। পান্নালাল যেন বহুমূল্য রত্ন পান্নার মতোই উজ্জ্বল। তাঁর এই ঘটা-ছটার পেছনে যদি কেউ থেকে থাকেন তিনি আমার বাবা, স্বর্ণযুগের স্বনামধন্য শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। কাকার খুব ইচ্ছে ছিল সিনেমার নেপথ্য গায়ক হবেন। আধুনিক গান গাইবেন। সেই মতো মেগাফোন কোম্পানিতে দুটো গানও রেকর্ড করেছিলেন। কিন্তু তখন বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগে রাজপাট শচীন দেব বর্মন, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্রদের। এদিকে পাঁচের দশকের পর ভক্তিগীতিতে নতুন শিল্পীর প্রয়োজন। যিনি কে মল্লিক, ভবানী দাস, মৃণালকান্তি ঘোষের যোগ্য উত্তরসূরী হবেন। কাকার মধ্যে ভক্তিরসের সেই জোয়ার ছিল। বাবা ছিলেন জহুরি। তাই রত্ন চিনে তাঁর সঠিক স্থান বলে দিতে পেরেছিলেন। নিজে নিয়ে গিয়েছিলেন এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানিতে। বলেছিলেন, আজ থেকে এখানে ভক্তিগীতির দায়িত্ব দিন পান্নাকে। ও কোম্পানির মুখ রাখবে। কাকা তাঁর মেজদাকে বেদবাক্য মানতেন। তাই আধুনিক, সিনেমার প্লেব্যাকের মোহ ত্যাগ করে অনায়াসে নিজের কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন মায়ের গান। বাবা যে কতখানি সঠিক ছিলেন তাঁর প্রমাণ আজও কালীপুজো এলে, শ্যামাসঙ্গীতের কথা উঠলে পান্নালাল ভট্টাচার্যের নাম জিভের ডগায় থাকে।
মায়ের পায়ের জবা হয়ে...
আমাদের পরিবার বরাবরের শাক্ত। আমার ঠাকুর্দার বাবা ছিলেন পুরোহিত। ফলে, আজন্ম আমাদের শরীরে ভক্তিরসের ধারা। বাবাদের ১১ ভাই-বোনের সবথেকে ছোট ছিলেন কাকা। তিনি যখন সাত মাসের গর্ভে তখনই মারা যান ঠাকুর্দা সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। ফলে, বাবা নিজের হাতে মানুষ করেছিলেন, গড়েছিলেন কাকাকে। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য তাই পান্নালালের কাছে বাবার সমান। আমার মা ছিলেন তাঁর মা। ১৮-১৯ বছর বয়সে বালিতে বারেন্দ্র পাড়ার মাঠে খেলতে খেলতে বল লেগেছিল কাকার চোখে। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি বলেন মেডিকেল কলেজেই একমাত্র এর চিকিৎসা সম্ভব। সেখানে নিয়ে এসে বাবা কাকার চিকিৎসা করিয়েছিলেন। তখনকার দিনে একেকটি ৪৫০ টাকা দামের মোট ২৫টি ইনজেকশন দেওয়ার পর কাকার চোখ বেঁচে গেল। কিন্তু চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, চোখের মণি সামান্য সরে যাবে। মা-বাবার সেবা-শুশ্রূষায় চোখ ফিরে পাওয়ার পর তাঁদের আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিলেন কাকা। ফুটবলের নেশা এতটাই ছিল যে মোহনবাগান হেরে গেলে কাকা গানের অনুষ্ঠান বা রেকর্ডিং বাতিল করে দিতেন। একই সঙ্গে তাঁর ঘুড়ির নেশাও প্রবল ছিল। আর ছিল দুই ভাইয়ের মাছ ধরার নেশা। মজার বিষয়, বাবা কাকার কাছে এতটাই আইডল ছিলেন যে বাবার মতো করে তিনি ধুতি পরতেন। হাঁটতেন, কথা বলতেন, এমনকি হাতের লেখার ভঙ্গিতেও বাবাকেই ছুঁতে চেষ্টা করতেন।
তুই বড় না মুই!...
কাকা ভক্তিগীতি গাইতেন বাবাকে দেখে। বাবার মতো করে। কারণ, তাঁর ধারণায় মেজদার থেকেও ভালো ভক্তিগীতি কেউ গাইতেই পারে না! ওই কারণেই কোনও অনুষ্ঠানে গেলে বাবার আগে গান গেয়ে উঠে আসতেন। বলতেন, মেজদা থাকলে গাইতে পারব না। আর বাবা বলতেন, অসংখ্য শ্যামাসঙ্গীত গাওয়ার পরেও পান্নার মতো আমি ওরকম নাড়ি ছেঁড়া মা ডাক ডাকতে পারলাম কই? একটি ঘটনা বলি। একবার বিখ্যাত ভক্তিগীতি গায়ক কে মল্লিকের পাড়ার অনুষ্ঠানে বাবা একঝাঁক শিল্পী নিয়ে গেছেন গান গাইতে। হঠাৎ ধবধবে সাদা চুল-দাড়ির এক বৃদ্ধ এসে সেই দলের মধ্যে কাকে যেন খুঁজছেন। তিনিই বিখ্যাত শ্যামাসঙ্গীত শিল্পী কে মল্লিক। সবাই তাঁকে প্রশ্ন করছেন, কাকে খুঁজছেন তিনি? উত্তরে সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, পান্নালালকে। কাকাকে তখন তাঁর সামনে দাঁড় করাতেই কে মল্লিক নাকি জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, 'এমন ভাবে কী করে গান গাস তুই? কী করে এমন করে মাকে ডাকতে পারিস?' সেদিন সবাই স্তব্ধ হয়ে দেখেছিলেন এক সাধক-গায়ক কীভাবে আরেক সাধক-গায়ককে, তাঁর যোগ্য উত্তরসূরীকে চোখের জলে বরণ করে নিচ্ছেন।
মা তুঁতে বেনারসী পরেছেন...
কাকা কিন্তু কোনোদিন নিজেকে নিয়ে, নিজের গান নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। আমার বাবার অনেকবার মাতৃদর্শন হয়েছিল। স্বপ্নে মা ভবতারিণী এসে মাকে দেখা দিয়ে বলেছিলেন, তোর হাতে মাছ খাব। বাবা খাইয়েছিলেন। কাকার জীবনেও অলৌকিক ঘটনা আছে। কিন্তু বাবার মতো কোনোদিন মাতৃদর্শন হয়নি। একবারে ফাংশান শেষে শিল্পী বন্ধুদের সঙ্গে ট্রেনে করে ফিরছেন। হঠাতই বালি নামার একটু আগে কাকার মুখ লাল। চোখে জল। কাকা বলে উঠলেন, মাকে তুঁতে বেনারসী পরানো হয়েছে! কেউ বিশ্বাস করছেন না কাকার কথা। শেষে কাকা বললেন, নেমে চল দেখে আসি। কাকার কথায় হইহই করে ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষের মতো শিল্পীরা। মন্দিরে গিয়ে দেখলেন, ভবতারিণী তুঁতে রঙের বেনারসী পরে সেজেছেন! সবাই মুখ চাওয়াচায়ি করেছিলেন দেখে। এটা তো একটা উদাহরণ। এরকম আরও ঘটনা কাকার সঙ্গে ঘটেছে। কিন্তু সঠিক আধার না থাকায়, আদর্শ গুরু না পাওয়ায় মায়ের এই কৃপা কাকা ধরে রাখতে পারেননি। প্রতি কালীপুজোয় বাবার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে কালীপুজোর অনুষ্ঠান করার পর সেখানেই সারারাত কাটাতেন কাকা। তবু কাকা কোনোদিন মাকে দেখতে পাননি।
আসবি নে তোর এমন সাধ্য নেই...
যত দিন গেছে এই তৃষ্ণা কাকার আরও বেড়েছে। কাকার একটাই যন্ত্রণা, মেজদাও শ্যামাসঙ্গীত গেয়েছেন। তিনিও গান। তাহলে মা কেন মেজদার কাছে আসবেন, তাঁর কাছে নয়! আস্তে আস্তে ঘোরতর সংসারী কাকা সংসারের বন্ধন ছিঁড়েছেন। প্রায়ই গিয়ে শ্মশানে বসে থাকতেন। আর শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে মাকে ডাকতেন। তাঁকে একবার দেখার জন্য পান্নালাল ভট্টাচার্যের সেই আকুতিই তাঁর প্রতি গানে ঝরেছে। যে কাকা নিজের হাতে তাঁর মেয়েদের চুল বেঁধে দিতেন, দারুণ রাঁধতে জানতেন, কাকিমার জন্য নিজে পছন্দ করে শাড়ি এনে দিতেন, সেই কাকা আস্তে আস্তে সংসার থেকে সরতে আরম্ভ করলেন। মাকে পেতেই হবে, এই লক্ষ্য নিয়ে। যেন মা আসলে তিনিই যাবেন মায়ের কাছে। জীবদ্দশায় ৩৬টি আধুনিক গান সমেত ১৮টি রেকর্ড, ৩টি বাংলা ছায়াছবির গান, এবং ৪০টি শ্যামাসঙ্গীতের রেকর্ড কাকার। শ্রী অভয় নাম দিয়ে তাঁর লেখা, সুর করা বেশ কিছু শ্যামাসঙ্গীত আছে।
ওপার আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে...
অভিশপ্ত ১৯৬৬ সাল। ওই বছরেই বাবার সুরে কাকা রেকর্ড করলেন 'অপার সংসার নাহি পারাপার'। আর ওই বছরেই মাত্র ৩৬ বছর বয়সে, দেবী দর্শন না করতে পারার অবসাদ, অতৃপ্তি নিয়ে কাকা নিজেকে শেষ করে দিলেন। 'আমার সাধ না মিটিল', 'তিলেক দাঁড়া ওরে শমন', 'মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানি না মা', 'ওপার আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে', 'মা তোর কত রঙ্গ দেখব বল' গানে অভিমানী পান্নালাল শুধুই তাঁর মা কালীকেই খুঁজে ফিরেছেন। কাকা অকালে চলে যাওয়ার পরে বাবা সন্তান হারানোর শোকে ভেঙে পড়ে তীব্র অভিমান নিয়ে তাই মায়ের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন দুটি গানে। দুটি গানেই পান্নালালের কথা--- 'ত্রিভুবন জয় করিয়া রাবণ আনিল রত্নরাজি/ গড়েছিল তার স্বপ্ন রাজ্য পান্না যে তার নাম', 'থির হয়ে তুই বস দেখি মা দুটো কথা কই/ আজ আছি মা শান্ত হয়ে কাল যদি না রই'!
Click for more
trending news