নয়াদিল্লি: রাজনীতি, কূটনীতি আমার বরাবরের পছন্দের বিষয়। ছেলেবেলায় সবাই যখন ঠাকুরমার ঝুলি, রাক্ষস, খোক্কস, রূপকথার গল্প শুনে বড় হয়েছে, আমি সেখানে রাজনীতির অলিগলিতে পড়ে থাকা বিভিন্ন কাহিনী শুনেছি, মায়ের কাছে। রাজনীতির প্রাথমিক পাঠ বলতে গেলে পুরোটাই মায়ের কাছে, বাকিটা কাজ করতে এসে, আমার দুই গুরুর থেকে শিখেছি, তাঁদের নাম এখানে লিখছি না একাধিক কারণেই। বিভিন্ন সহকর্মী, জুনিয়র, সিনিয়র সবার থেকেই যখন যা পেয়েছি, স্মৃতিতে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। খবরের কাগজ মানে গ্রামের, পাড়ার অনেকের কাছে যখন ছিল খেলার পাতা, গ্রামের আমি ও আমারই এক বন্ধুর নজর থাকত প্রথমপাতা, যেখানে দেশের খবর, রাজ্য রাজনীতি, কূটনীতির খবরের পাতা। তা নিয়ে চলত আমাদের আলোচনা,যুক্তি তক্কো।
পরে সাংবাদিকতার পেশায় এসে রাজনীতি ও কূটনীতির খবর লিখেছি, বিশদে চর্চা করেছি। অনেক সহকর্মী, প্রাক্তন, বর্তমান সবার সঙ্গে আমার বরাবরই ভাল সম্পর্ক। তেমনই একজন মানুষ প্রসেনজিৎদা মানে প্রসেনজিৎ চৌধুরী। প্রসেনজিৎদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অসাধারণ, মনে আছে, আমি যখন কাজ শুরু করি, আমায় দিয়ে নিজের কপির অ্যাঙ্কারপার্ট বা সঞ্চালকের অংশটি লেখাত, ভুল হতে উফফ, মনে পড়লে হাসি পায়, আ ঠিক হলে কিন্তু সবাইকে ডেকে দেখাত, প্রশংসা করত। সেই প্রসেনজিৎ দার লেখা ড্রাগনভূমির অজানা রহস্য বইটা প্রকাশের পরেই, খোদ লেখক প্রসেনজিৎদার সঙ্গে কথা বলে বইটা দিল্লিতে আনাই।
এত কথা লিখলাম, এই কারণেই, যে লেখকের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক কেমন, সেটা জানাও জরুরি, ফলে এহেন একজনে বই হাতে পেয়ে আমি খুবই আপ্লুত। আরও আপ্লুত হলাম যখন বইটা পড়া শুরু করলাম।
শুরুটা হয়েছে ভুটানের রাজবাড়ি দিয়ে। রাজার খুন হয়ে যাওয়ার ঘটনা দিয়ে বই শুরু, ভারত-ভুটান কূটনৈতিক সম্পর্ক। সেই সময় রানি ছিলেন আমাদের কলকাতায়। তাঁর নিরাপত্তা, ফেরানো ইত্যাদি দিয়ে। যথই পাতা কমতে লাগল, চমকে উঠলাম। কত কিউ যে লিখেছে, প্রতিটা পাতায় তথ্য। কূটনীতির অলিগলি, রাজনীতির গন্ধমাখা পথের দুধারে কূটনীতির শেওলা পড়ে আছে, যেখানে পা পড়লে যে কোনও সময়ে পিছলে যেতে পারে।
আস্তে আস্তে এলাম এক বিচিত্র অধ্যায়ে। যেখানে সিকিমের কথা তুলে ধরা হয়েছে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু ও তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধির খচ্চরের পিঠে চেপে সিকিমের খাড়াই পথে ভ্রমণ। কী যে দারুণ শব্দের বুনন, তথ্যের জাল। আহা, পড়তে পড়তে মন চলে যায় সিকিম-ভুটানের খাড়াই পথে। এককথায় গোটা বইটাই যেন পড়তে পড়তে রহস্য।
ভুটানরাজ জিগমে দোরজি ওয়াংচুর কেনিয়ায় মৃত্যু ও তার পরবর্তী রাজা হিসেবে জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুর সিংহাসনে বসা ও তা নিয়ে বৈঠক, গোপন চক্রান্তের সহস্যের গন্ধের আঁচ পাওয়ার গল্প পড়তে পড়তে মনে হয়, রাজনৈতিক বা কোনও কূটনৈতিক কাহিনী নয়, এ যেন কোনও ক্রাইম থ্রিলার, যার পড়তে পড়তে রহস্য। ভুটান রাজপ্রাসাদে বাড়তে থাকা ষড়যন্ত্রের জালের সন্ধান পেতে ইচ্ছে করে, সেই দেশ, সেই রাজা জিগমে দোরজি, যিনি সিংহাসনে থাকাকালীনই প্রধানমন্ত্রী খুন হন, যে ঘটার নেপথ্যে ভুটান-রাজপ্রাসাদে বেড়ে চলা ষড়যন্ত্র, পারষ্পরিক হিংসা, রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়া বিষবাষ্পের কথা উল্লেখ করেছেন লেখক প্রসেনজিৎ চৌধুরী ওরফে প্রসেনজিৎদা।
১৯৫৮ সালে ভুটানের পারো শহরে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, সেকথা আমি আগেই লিখেছি, তার প্রায় তিন দশক পরে থিম্পু গিয়েছিলেন বাংলার প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী তথা বাম নেতা জ্যোতি বসু। তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল রয়্যাল ভুটান আর্মি, তাঁদের অভিবাদন নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে নিখুঁত শব্দজালের বুনট।
ইন্টারনেটের যুগে লেখার পরিধি ছোটো হয়ে এসেছে। ফলে বইটির মূল বিষয়গুলি ছুঁয়ে যাওয়া ছাড়া সেভাবে লেখা সম্ভব নয়, খবরের কাগজ হলে হয়তো অনেক বেশী লেখা যেত। বইটার শেষ দেওয়া অ্যালবাম এবং সঙ্গে রাখা নোটগুলি দেখা দারুণ লাগল, ব্যক্তিগতভাবে আমার।
তবে বইটা আমি পড়ে যতটা না বুঝলাম, তার থেকে অনেক বেশী তথ্য সমৃদ্ধ হতে পারলাম। জানি না, কতটা মনে রাখতে পারব, কতটা পারব না। মনের আনন্দ থেকে এই লেখাটা লিখলাম। বইটা নিয়ে সেইজন্য কম লিখলাম, স্বল্প পরিসরে শুধু ছুঁয়ে গেলাম আমার ভাল লাগার জায়গাগুলো।
থ্রিলার দিয়ে শুরু, ভ্রমন দিয়ে শেষ করা বইটা পড়ে সত্যই দারুণ লাগল। প্রসেনজিৎদা, মানে প্রসেনজিৎ চৌধুরীর থেকে আমার ব্যক্তিগতভাবে পরবর্তী চাহিদা, তাঁর উল্লেখিত আমু শেরিং-এর কাহিনী।