নয়াদিল্লি: ভাষার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঠিক কেমন, তা লিখে বা বলে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমরা যারা বাংলাভাষা নিয়ে কাজ করি, তাদের কাছে এই ভাষার গুরুত্ব অনেক। শুধুমাত্র বাংলা নয়, প্রত্যেক ভাষারই নিজস্ব কতগুলো ধরণ আছে, বিভিন্ন ভাব প্রকাশের ধাঁচ আছে, আর্ট আছে। ভাষা তো শুধুমাত্র ভাব বা কোনওকিছু প্রকাশের মাধ্যম নয়, ভাষার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে সেই অঞ্চলের বা জনজাতির কৃষ্টি, সংস্কৃতি, পরম্পরা। ভাষার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই পরিবর্তন হয়, সেই জনজাতির সংস্কৃতি, কৃষ্টি। ফলে ভাষার গুরুত্ব অনেক। সেই কারণে আমরা এই ভাষায় সবসময় কথা বলি, সারদিন নানা কাজকর্ম থেকে শুরু করে বিতর্ক, চায়ের কাপে বিতর্কের তুফান তুলেও, সারাজীবনে এই ভাষাটা সঠিকভাবে জানতে পারি না।
আর এই কঠিনতম বিষয়টা নিয়েই আজকে লিখতে বসেছি, তবে বিষয়টা একটু অন্যরকম, ভাষার পরিবর্তন, সংস্কৃতির পরিবর্তন।
আচ্ছা, ধরুণ আপনি গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, রাস্তার দুধারে ছোটো, বড়, মাঝারি গাছের সারি রয়েছে। বৃষ্টিতে বাঁচার জন্য একটা বড় গাছের তলায় দাঁড়ালেন, আপনি কি এখনও গাছের তলায় দাঁড়িয়ে বলেন, লেবু পাতায় করমচা, এই বৃষ্টি থেমে যা। আজ থেকে ১০ বছর বা ১৫ বছর পিছনে ফিরে গেলে এই দৃশ্য বা কথাটা আপনি শুনতে পাবেন।
হারিয়ে যাওয়া খেলা: স্মৃতিপটে আজও অমলিন সেই বিকেলগুলো
বর্ষার পর, শরৎ আসে, অনেক সময় দেখবেন পুজোর আগের সময়টায় রোদও ওঠে, বৃষ্টিও পড়ে। সেই সময় ছেলেমেয়েরা বলত, রোদ হচ্ছে, বৃষ্টি হচ্ছে,খেকশিয়ালের বিয়ে হচ্ছে। এইরকম অনেক প্রবাদ প্রবচন আছে, যা আমাদের দৈনন্দিন কথোপকথন থেকে হারিয়ে গিয়েছে। গরমের দিনে হাঁসফাঁস করতে করতে আমরা ছোটোবেলায় বলতাম, আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেবো মেপে। গ্রামবাংলার এগুলো ছিল দৈনন্দিন কথোপকথন, প্রকৃতির সঙ্গে আবহাওয়ার সঙ্গে কথোপথন। শহরের হোক, গ্রামের, মানুষের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে, রামধনু।
আমার সঙ্গে এক বন্ধুর কথা হচ্ছিল। কথায় কথায় আমি কুটুম্ব বা অপভ্রংশে কুটুম শব্দটি ব্যবহার করেছি বলে তার খুব রাগ। তার ধারণা, এই শব্দটি “গেঁয়ো” , তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না, কুটুম্ব শব্দটি বাংলার আদি ভাষা বা সনাতনী বাংলা ভাষা। আর এখানেই আরও একটা জিনিস বুঝলাম, আগে আমাদের বাড়িতে কুটুম্ব বা কুটুম আসত, এখন গেস্ট আসে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে ভাষা, বদলাচ্ছে সংস্কৃতি, ভাব প্রকাশের ভাবভঙ্গি।
বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে গিয়েছে, ট্রাঙ্কল, ডায়াল ঘোরানো ফোন। তার জায়গা নিয়েছে আঙুলের স্পর্শমাখা স্মার্টফোন। সোনালি খামে প্রিয়জনের নাম লেখা চিঠি বাড়িতে আসেনা। দুর্গাপুজোর পর বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা জানিয়ে বা পরীক্ষা শেষে কচিকাচাদের হাতের লেখা চিঠি কোনও বাড়িতেই আসে না।
বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা এখন পরিণত হয়েছে উইশ-এ। হোয়াটসঅ্যাপে উইশবার্তা আসে, সঙ্গে মিষ্টির ইমোজি, বা স্টিকার। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে, বন্ধুত্বের সংজ্ঞা, সম্পর্কের সংজ্ঞা। হাতে হাত মিলিয়ে জড়িয়ে ধরে বন্ধুত্ত্বের আন্তরিকতা এখন স্থান পেয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকের দেওয়ালে। পাড়ার পাড়ায় রকের আড্ডার দিনগুলোও হারিয়েছে।
অল্প কথায়, চটজলদি সময়ে, পুরো বিষয়টার ওপর আলোকপাত করা সম্ভবপর নয়, ফলে লেখাটা শেষ করতেই হচ্ছে, তবে একটা প্রশ্ন রাখব, মাননীয় পাঠকদের কাছে, সভ্যতার আগ্রগতি মানেই কি ভাষা, সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়া, উন্নতি মানে কি কৃষ্টি সংস্কৃতিকে ব্যাকেডেটেড বলে, নতুনকে আঁকড়ে ধরলেই কি নিজেদের এগিয়ে থাকা মানুষ মনে করা যায়? আগামীদিনে সমাজ, বিজ্ঞান, সভ্যতার আরও অগ্রগতি হবে, তাহলে বর্তমান, এবং ফেলে আসা দিন, সভ্যতা, দিনযাপনগুলোর কোথায় ঠাঁই হবে, একটু ভেবে দেখবেন।