This Article is From Jun 29, 2019

হারিয়ে যাওয়া খেলা: স্মৃতিপটে আজও অমলিন সেই বিকেলগুলো

নিউ দিল্লি:

গুরগাঁও এর অভিজাত ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কফি মগে শেষ চুমুকটা দিল কৃশানু। এখানে প্রায় বছর খানেক হল। একটি নামী সংবাদ মাধ্যমের অফিসে স্পোর্টস জার্নালিস্ট সে। আনন্দপুর গ্রামের ছেলে বল্টু এখন কৃশানু ব্যানার্জি। সপ্তাহের প্রথমদিন অফিস গিয়েই স্পোর্টস এডিটর বলে দিয়েছেন, বিশ্বকাপ আর কোপা আমেরিকায় ডুবে না থেকে নতুন কিছু লিখতে, আর তাতেই চিন্তামগ্ন সে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের ঝাঁ চকচকে অফিসগুলো দেখতে দেখতে, একটা সিগারেট ধরাল কৃশানু। রিং-এর ধোঁয়ার মধ্যে আবছাভাবে সে গ্রামের ফেলে দিনগুলো দেখতে পেল। অতীত আর বর্তমানের কানাগলিতে ঢুকে পড়ল ক্রীড়া সাংবাদিক কৃশানু ব্যানার্জি।

তার মনে পড়ল, সেই সময়ের বিকেলগুলোর কথা। কতদিন যে মায়ের কাছে সে বকুনি খেয়েছে, এমনকী, মাঝেমধ্যে দু এক ঘাও জুটেছে, কপালে। বাড়ির সামনে সবুজ মাঠটায় প্রতিদিন বিকলে খেলা হত। এক  একদিন একরকম খেলা হত, সেটা নির্ভর করত কতজন জমা হয়েছে তার ওপর। কোনওদিন বুড়িবসন্ত, কোনও কানামাছি, কুমিরডাঙ্গা বা জলকুমারি, কুমিরডাঙ্গা খেলাকে ওরা বলত জল কুমারি খেলা। কাবাডি খেলতে গিয়ে কতবার যে, জামা ছিঁড়ে বাড়ি এসেছে, সসব মনে পড়তেই হাসি পেয়ে গেল কৃশানুর। আর তারমধ্যেই একটা ভাল সাবজেক্ট পেয়ে গেল ও, লিখতে বসল, হারিয়ে যাওয়া গ্রামের খেলাগুলোকে নিয়ে।

ej2jrlqg

পাড়ার মধ্যে ওই একমাত্র ছিল, স্থানীয় নামী ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্র। ফলে পাড়ার সবার কাছে ছিল আদরের। পড়াশোনায় ভাল হওয়ার জন্য পাড়ার সবার সঙ্গে মেলামেশা ছিল অবাধ, সেই সঙ্গে ওর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল প্রাণোচ্ছ্বলতা। হইচই করে থাকা সবসময় ও সবাইকে মাতিয়ে রাখত। এসব ভাবতে ভাবতে বুড়িবসন্ত খেলার কথা মনে করে করে লিখতে থাকল কৃশানু।

লম্বা হওয়ার দারুণ ছুটতে পারত ভাল। ফলে খেলার নিয়ম অনুযায়ী, ওকেই সবাই বুড়ি বসাত। আর বাকিরা, ফিল্ডিং দিয়ে চু-কিত কিত করে যেত। ও যে ফিল্ডিং করত না, তা নয়, তবে কম। কারণ, বুড়ি বসতে গেলে প্রচণ্ড জোরে ছুটতে হত না হলে গেম দেওয়া যায় না। দাগ কাটা নিজেদের ঘরে পৌঁছানোর আগেই কেউ ছুঁয়ে দিলে আউট হয়ে যেত, ফলে ছুটে নিজেদের ঘরে পৌঁছানোর দায়িত্ব সামলতে বুড়ি বসতে হত তাকেই। এটা ওর কাছে খুবই মজার ব্যাপার লাগত। রোজ বিকেলে পড়াশোনার কাজ শেষ করে সামনের ফাঁকা মাঠে খেলতে যেত বল্টু। তখন স্কুলের নাম ডাকার খাতাতেই সে শুধুমাত্র কৃশানু, বাকি সময় জায়গায় তখনও সে বল্টুই।

k4eo8na

সবাই যে প্রতিদিন খেলতে আসত, তাও না। যেদিন একটু সংখ্যা কম হত, সেদিন আর বুড়িবসন্ত নয়, খেলা হত লুকোচুরি। আজ হঠাৎ ভাবতে লাগল কৃশানু, বল্টু থেকে কৃশানু, বা অফিসে কারও কাছে কৃশ হয়ে ওঠার প্রতিটি পদক্ষেপে জীবনে কত না লুকোচুরি খেলতে হয়, জীবনের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি পদক্ষেপে লুকোচুরি। অথচ কত মজা করে এই খেলাটা সে খেলত। ওর কলমে ফুটে উঠল সেই খেলার দিনগুলোর কথা। কিছুতেই নিজের চোখ বাঁধতে দিত না। বরং চোখ খোলা রেখে, অন্যের বন্ধ চোখে খুঁজে বেরানো উপভোগ করত। আর সেটা লিখতে লিখতেই ভাবনার গভীরে ডুব দিল কৃশানু।

ভাবনায় ডুবতেই প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল সে। ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেটটা চেপে ধরেই লিখতে আরম্ভ করল।

গ্রাম গঞ্জের অলিগলিতে তখনও স্কুল তৈরি হয়নি, সবাই ছিল ইস্কুলের ছাত্র। বল্টু মানে কৃশানুর ছাত্রজীবনের শুরুটা স্কুলে হলেও, সিক্সে উঠে সে ভর্তি হয় ইস্কুলেই। কারণ, তারপর ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে পড়ার মতো না ছিল তাদের পারিবারিক সামর্থ, না ছিল তখন এত স্কুল।

যাই হোক, প্রতিদিনের টিফিন পিরিয়ডটা জমিয়ে উপভোগ করত কৃশানু মানে বল্টু। স্কুলের বারান্দার সিঁড়িতে রোজ কুমিরডাঙ্গা খেলা হত। মানে, নীচে কেউ নামতে পারবে না। অর্থাৎ নীচের অংশ মানে মাঠটা ছিল জল, মানে ওখানে শুধু কুমির থাকবে। একবার একবার সবাই পা ফেলে কুমিরকে সুযোগ দিত। আর সবাই বলত, “কুমির তোর জলে নেমেছি”। কুমির তাদের ছোঁয়ার চেষ্টা করত, আর ছুঁয়ে দিলেই, তাকে কুমির হতে হত। যদিও কৃশানু কখনও নিজে কুমির হওয়ার সুযোগ দিত না।

শুধু কী স্কুলেই, বাড়িতে বোনদের সঙ্গে খেলাতেও তার জুরি ছিল না। বুড়িবসন্ত মানে বৌ-চি খেলা ছাড়াও থাকত কিতকিত খেলা, জুতো চোর খেলা। নিজের বোনের সঙ্গে খেলাঘরের সদস্যও হয়েছে বহুবার।

s8jofhoo

প্রচণ্ড জোরে ছুটতে পারায় জুতো চুরি করার দায়িত্ব বর্তাত ওর ওপরেই। দাগের ওপারে জুতো আগলে থাকত একদল, তাদের থেকে জুতো ছিনিয়ে আনার চেষ্টা  করে যেত আরেক দল। এই ব্যাপারটা বেশি চ্যালেঞ্জিং লাগত কৃশানুর। কোনওবারই অসফল হয় নি সে। সফলভাবে জুতো চুরি করে এনে দলকে জেতাত পাড়ার ছেলে বল্টু।

নিজের সবচেয়ে পছন্দ ছিল ক্রিকেট খেলা। টাকা না থাকায় প্রাইমারি স্কুলের গায়ে ইঁটের টুকরো দিয়ে রং করে, কখনও আবার ইঁট নিয়ে এসে উইকেট বানিয়ে চলত ক্রিকেট। শর্ট ক্রিকেট খেলতে নেম ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যাট করে যেত অসীম ধৈর্যবান কৃশানু, সচিন ওর প্রিয় ক্রিকেটার হলেও, রাহুল দ্রাবিড়ের মধ্যে ও আলাদা ক্যারিশ্মা খুঁজে পেত। দুই ক্রিকেটারকে মনে গেঁথে নিয়ে নিজস্ব ঘরানা তৈরি করে খেলত ও।

লেখাটা আর খুব বেশী বড় করতে ইচ্ছে করল না কৃশানুর। শুরুর উৎসাহটাও কোথায় গিয়ে যেন হঠাৎ করেই খেই হারিয়ে গেল। দ্রুত একবার ফিরে গেল পুরানো ফেলে আসা দিলগুলোয়। এক নিমেষে চোখের সামনে ভেসে উঠল কানামাছি, রুমাল চুরি, সাপ-লুডো, পিট্টু, খো-খো, ডাং গুলি, পাড়া ক্রিকেট, প্লাস্টিকের বলে শর্ট ক্রিকেট, দল বেঁধে পাশের গ্রামে শীতের দুপুরে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট দেখতে যাওয়া, বিকেলের ভলিবল , বর্ষায় ভিজে ফুটবল, ভরা বর্ষায় নদীতে সাঁতারের দিনগুলো।কানে স্পষ্টভাবে শুনতে পেল, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ......

মনটা কেমন যেন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল ওর। সেইসব মুখগুলো ঝাপসা থেকেই ক্রমেই ওর চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল। মন খারাপের গভীর রাতে লেখা শেষ করে ল্যাটপটটা বন্ধ করে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল কৃশানু ব্যানার্জি। লর্ড টেনিসনের লাইনটা মনে পড়ল ওর....

Time marches on, but memory stayes

torcharing silently the rest of out days

.