চৌধুরীবাড়ির ছাদে প্যান্ডেল হচ্ছে। হতেই পারে, এ আর এমন কী কথা! ভারতীয় হল এমন এক প্রজাতি যে বিয়ের খবরেও মিষ্টি খেতে চায়, আবার শ্রাদ্ধবাড়িতেও মিষ্টি নিয়ে যায়। সেখানে শীতকালের মরশুমে ছাদে প্যান্ডেল হচ্ছে, নতুন কী! এই সিজনে প্রতি পাড়াতেই দু'ঘর অন্তর অন্তর হয় কারো বিয়ে থাকে বা কারো শ্রাদ্ধ। কিন্তু চৌধুরীদের প্যান্ডেল ঠিক সাদাটে মরা মরা নয়, আবার গোলাপি, লাল মার্কা অমুক ওয়েডস তমুক টাইপেরও নয়। অন্নপ্রাশন? জন্মদিন? সত্যনারায়ণ? ভাবতে ভাবতেই রিংটোনে বেজে ওঠে চৌধুরী বাড়ির একমাত্র ছেলেটি।
“প্যান্ডেল হচ্ছে দেখতেই পাচ্ছিস নিশ্চয়।”
“হ্যাঁ, তবে তোর বিয়ে হওয়ার তো এখনই কোনও কথা ছিল না।”
“হচ্ছেও না ব্রো!”
“দূরসম্পর্কের কেউ মারা-টারা....?”
“হুঁ, দূরসম্পর্কের না, সম্পর্ক ইটসেলফ মারা গেছে।”
“মানে!”
“ব্রেক আপ, ব্রেক আপ। তানিয়ার সাথে ফাইনালি কাটিয়ে দিয়েছি।”
“তার সাথে প্যান্ডেলের কী সম্পর্ক!”
“এত ফোনে বলা যাবে না, আগামীকাল নিমন্ত্রণ রইল, শেষবেলায় ভালো করে আর চিঠি দিয়ে জানাতে পারলাম না, কার্ডটা মেল করেছি। চলে আসিস”
“কিসের কার্ড!”
“পার্টির! আমাদের ব্রেক আপ পার্টি।”
মেলের নোটিফিকেশনে টাটকা একটা ই-বার্তা, ই-ইনভিটেশনও বলা যায়। আশমানি রঙের কার্ড, হাতে লাইক পোজিশন করে তানিয়া আর মিলনের পাসপোর্ট সাইজ ছবি বসানো। লাইক দেখাচ্ছে না কাঁচকলা এই মুহূর্তে সেইটা পরিষ্কার না। মাঝে একটা ডিজিটাল পেইন্ট করা ফাটলের ছবি।
ভাঙনের রঙ বুঝি আশমানি?
কিছু সম্পর্ক কাচের মতো ভাঙে, কিছু সম্পর্ক দুঃস্বপ্নের মতো। তা, জোড়া লাগালে যদি গণ্ডাখানেক লোককে গিলিয়ে উদ্ধার করতে হয়, ভাঙার বেলা কিপটেমি কীসের? প্রবল শোকেও মানুষ শ্রাদ্ধে টাকা ঢালে, মরার খাটিয়ার পাশে বসেও পুরোহিত ভালো চাল আর মোটা কলা না হলে রেগে যান। শ্রাদ্ধও তো আসলে সম্পর্কের মৃত্যু উদযাপন। কেবল প্রেম ভাঙার বেলা প্রশ্ন! আসলে প্রেম বলেই এত প্রশ্ন। প্রেম এবং কোষ্ঠকাঠিন্য হল সেই দু'খানা বিষয় যাতে সকলেই উপদেশ দিতে ভালোবাসেন। বিষয়টা আসলে নতুন কিছুই না, অভ্যাসে আনাটা নতুন। শুনুন মশাই, ইদানীং আর সনাতন বলে কিছুই নেই। যাহা আছে তাহাই গ্লোবাল। আমরা বরাবর টুকে পাশ করা জাতি। সংবিধান টুকেছি, পোশাক টুকেছি, সকালের জলখাবার টুকেছি এমনকী আড্ডাকেও ভার্চুয়াল হ্যাং আউট দিয়ে বদলে ফেলেছি। আসলে সকলই অভ্যাস। আর এই প্রজন্ম বলছে, অভ্যাসই ‘কুল', তর্ক ভুল। তাই জোড়া লাগানোর যদি উৎসব হতে পারে, ভেঙে ফেলারই বা কেন না? প্রায় প্রতিটা প্রথম বিশ্বের দেশেই ব্রেক আপ পার্টি ফ্যাশনে ইন। তা সে বৈবাহিক সম্পর্ক হোক, বা প্রেমের। আর প্রথম বিশ্ব শুনলেই দেখবেন জিভে কাতুকুতু লাগে, ‘আমিও করব, আমিও টুকব' জাতীয় একটা হরমোনাল সিক্রিয়েশন হয়। তাই আমরাও ভাঙনের উৎসবে নাম লিখিয়ে ফেলি।
উদযাপনের আবার হরেক কিসিম পন্থা। মানে ধরুন, কেক কাটা হবে। কেকের ডিজাইনে দেখা গেল আপনি আপনার প্রেমিকার মাথায় হাতুড়ি মারছেন। অথবা ধরুন, সম্পর্কে থাকাকালীন আপনাকে আপনার প্রেমিক যতো উপহার দিয়েছে সব ডাই করে আগুন জ্বালানো হল। এটা খানিক দোলের আগে ন্যাড়াপোড়া ফিল আরকি! তাতে আপনি আগুন জ্বালানোর মশাল নিয়ে একটা পাসিং দ্য পাসার টাইপেরও খেলতে পারেন। “যার হাতে থামল মশাল, তারই আবার পুড়ল কপাল” জাতীয় মন্ত্র আউড়ে আপনি তার গলায় ঝুলেও পড়তে পারেন। সেক্ষেত্রে এটাকে ব্রেক আপ কাম স্বয়ম্বর বলে চালাতে হবে। মানে এ সকলই সম্ভব।
তো যা বলছিলাম, কীভাবে ভাঙনকে আরও মুচমুচে করে তোলা যায় এ নিয়ে প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে ব্যবসার ‘তু-তু, ম্যায়-ম্যায়' রয়েছে জম্পেশ। ব্রিটেনে রিদম অফ লাইফ বলে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি রয়েছে যারা ডিভোর্স পার্টির ব্যবস্থা করে দেয়। পার্টিতে সেই সদ্য ব্রেক আপ হওয়া মানুষেরা নিজেদের একসাথে কাটানো সুসময়ের কথা ভাগাভাগি করে, ইচ্ছে করলে দুঃখপ্রকাশও করে। ব্রিটেনেই রয়েছে ডেবেনহ্যামস নামের দোকান। ধরুন সম্পর্কে থাকাকালীন আপনাদের মধ্যে স্বামীর দায়িত্ব ছিল নিয়ম করে ওয়াশিং মেশিনে কাপড় কাচা। প্রেম চটকে গেছে বলে তো জামাকাপড় না কেচে থাকা যায় না! তাহলে? কুছ পরোয়া নহি। ডেবেনহ্যামস আপনার বাড়িতে ডিভোর্স গিফট হিসেবে ওয়াশিং মেশিন পৌঁছে দেবে। আপনি দিব্য স্বনির্ভর হয়ে উঠবেন। ওয়েডিংরিংকফিন.কম সাইটে আবার ছোট ছোট কফিনও বানিয়ে দেবে মনের মতো ডিজাইনে। বিয়ের আংটি সেই ছোট্ট কফিনে ভরে প্রেমকে কবরচাপা দিয়ে দিতে পারেন। কবর দেওয়ার দিন পার্টিও হয়ে যেতে পারে ছোট্ট করে।
ওই যে বলছিলাম, শ্রাদ্ধও আসলে সম্পর্কের মৃত্যু উদযাপনের একটা পথ। এসব বস্তুগত সুবিধাই কী সব? উঁহু উঁহু। আপনি বেশ একটা আধ্যাত্মিক, পরিবেশ, পজিটিভ ভাইভস জাতীয় বিষয় পছন্দ করলে তার ব্যবস্থাও করে দেবে বাজার। বাজার মানেই বিশ্ব। যেমন গ্রেট নর্দান ফায়ারওয়ার্ক কোম্পানি। মাঠ ভাড়া নিয়ে আপনি সারারাত ফানুশ ওড়ান, সারারাত আতশবাজি জ্বালান। লোকজনকে বোঝান, আপনি এক্কেবারে ঠিক আছেন। বোঝান, প্রেম ভাঙলেও জীবনে টাকা নষ্ট এবং উচ্ছ্বাস প্রকাশের কোনও কমতিই আপনার নেই।
এই প্রথম বিশ্ব আর আমাদের মধ্যে এই যে নিবিড় যোগসূত্র, এর নেপথ্যে কে? আমাদের দেশি মিডলম্যানের নাম হল বলিউড। জোড়ি ব্রেকার্স বা লভ আজ কালের মতো সিনেমা থেকে শুরু করে হানি সিং আপনাকে এমন বেপরোয়া এক অগভীরতায় নিয়ে যাবে যে আপনার মনে হতে বাধ্য, সেলিব্রেশনই মূল উদ্দেশ্য। তা সে ভাঙনেরই হোক না কেন। কত কীই তো ভাঙে। ঘুম ভাঙার পর থেকেই একের পর এক আমরা আসলে তো ভেঙেই যাই। শরীর ভাঙি, নিজেকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি, সন্তানকে দেওয়া কথা সকলই ভেঙে ফেলি। প্রায় সব সকালেই নিয়ম ভাঙার গন্ধ থাকে আজকাল, সব রাতেই বিশ্বাস ভাঙার। একটা ভাঙন থেকে পালিয়ে আমরা অন্য ভাঙনের কাছেই যাই। ভাবি এটাই সবটুকু। সেই সবটুকু নিয়ে উৎসবে মাতি। ব্রেক আপ পার্টির আলো জ্বলে ওঠে। আসলে এত কিছু ভাঙতে ভাঙতে আমরা শেকল ভাঙার কথা ভুলে যাই। ভাঙা বাক্সটাই দেখি, বাক্স ভাঙা দিয়ে যে বাচ্চা খেলনা বানায় তার দিকে চোখ যায় না। নিজেকে পেঁচিয়ে থাকা অসুস্থ শিকল ভাঙার বদলে তাকেই ভালোবেসে ফেলি। প্রশ্ন করতে ভুলে যাই, মৃত্যুর কি কোনও উদযাপন হয়?
সে যা হোক, অত ভেবে কাজ কী! চৌধুরী বাড়ির প্যান্ডেলে আলো জ্বলেছে। আশমানি রঙ আলো। রাত ঠিক আটটা চল্লিশের লগ্ন মেনে ইন আ রিলেশনশিপ থেকে সিঙ্গল স্টেস্টাস বদল করবে মিলন। বড় এলিডি স্ক্রিনে ফেসবুক লাইভ ব্রেক আপ। সম্পর্কের তিক্ততা কাটাতে মেনুতে প্রথমে নিম আর উচ্ছে থাকলেও আশাবাদী ভবিষ্যতের লক্ষ্যে মেন কোর্সে বিরিয়ানি রয়েছে।
ভাঙতেও এত আয়োজন! ভাঙনের রঙ কি সত্যিই আশমানি? সম্পর্ক ভাঙলে আকাশ মেলে?
অত ভেবে কাজ কী,কবি তো কবেই বলেছেন, ব্রেক আপ সং, করদে দিল কী ফিলিং স্ট্রং!