কাঠিন্যের দূরত্বে নয়, স্নেহের বাঁধনে বাঁধা ছিল রায় পরিবার
কলকাতা: মুঠোফোনে একমাত্র তাঁকেই পাওয়া যায়। কারণ, সন্দীপ রায় এখনও টেলিফোনে আস্থাবান। প্রথমবার ব্যস্ততার ধ্বনি। দ্বিতীয়বারেই ফোন তুলে সেই আন্তরিক গলার আহ্বান, 'কেমন আছ?' তারপর হেসে ফেলে নিজের প্রশ্নে নিজেরই উত্তর, 'লকডাউনে যেভাবে থাকা যায়!' এবিষয়ে হান্ড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit Ray) বউমা। সন্দীপ-ঘরনি ললিতা রায় (Lalita Ray)। আজীবন নেপথ্যে থেকেও শাশুড়ি বিজয়া রায়ের মতোই যাঁর শ্যেনদৃষ্টি সবার শ্রদ্ধার ‘বাবুদা'র যাবতীয় কাজকম্মে। কিন্তু কোনোদিন তাঁর সাক্ষাৎকার চট করে চোখে পড়বে না কারোর। সেই নেপথ্যচারিণী আজ NDTV-র মুখোমুখি। রাঁধতে রাঁধতেই শ্বশুরমশাইকে নিয়ে অকপট সবার ভীষণ আদরের, প্রিয় ললিতা বউদি---
জন্ম শতবর্ষে ১০০ স্কুলের সত্যজিৎ স্মরণ ‘ইস্কুলে বায়োস্কোপ'-এ
লকডাউন নিয়ে কথা উঠতেই তাঁর আক্ষেপ, '১০ দিন অন্তর বাজারে যাচ্ছি। খেতে হবে তো কিছু। বাইরের সঙ্গে ওটুকুই সম্পর্ক আমার। বাবুর সেটুকুও নেই। ও দিব্য আছে। এই সুযোগে প্রচুর পুরনো নেগেটিভস, ছবির রিল আবিষ্কার করে ফেলেছে। এই তালিকায় রয়েছে, 'পথের পাঁচালী'র সময়কার নেগেটিভসও। এখন তো আর কেউ বিরক্ত করতে পারছে না। দরজা-জানালা বন্ধ করে ও এসব নিয়েই বেশ আছে। এমনিতেই বেশি বেরোয় না। এখন তো আরও মজা!'
বিশ্ব জুড়ে করোনা সংক্রমণ। দেশ, জেলা, শহর, লোকালয় ঘরবন্দি। কিন্তু শহর কলকাতা সেই ভয় সরিয়ে ২ মে এবং তার আগে থেকেই উদযাপনে ব্যস্ত ঘরের বিশ্ববন্দিত ছেলের জন্ম শতবর্ষ পালনে। হয়ত সভা হবে না। হয়ত সমাবেশও হবে না। প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ থাকায় স্পেশালি দেখানো হবে না কিংবদন্তি পরিচালকের বাছাই ছবি। কিন্তু এমন দিন যে এড়ানোও সম্ভব নয়! রায় বাড়ির ছবিটা আজ ঠিক কেমন? হেসে ফেলে লালিত্য মাখানো জবাব, 'বাবু ব্যস্ত নিজের কাজে, মহানন্দে। আর আমি? রাঁধছি-বাড়ছি। ফোন ধরছি, ছুটে ছুটে দেখতে যাচ্ছি রান্না পুড়ে গেল কিনা!'
বাবুদার মতো সত্যজিৎ রায়ও তো দারুণ উপভোগ করতেন লকডাউনকে? হাজারো ইনডোর গেমস, মিউজিক, বই, স্কেচ, পিয়ানো নিয়ে ? 'একদম ঠিক বলেছ', সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন জানিয়ে বললেন রায় বাড়ির বউমা। সঙ্গে এও যোগ করলেন, 'বাবার সমস্যা হত না ঘরে বসে সময় কাটানোয়। হয়ত একাধিক গল্পই লিখে ফেলতেন। ফেলুদা বা অন্য কিছু নিয়ে। তবে দুর্দিন নিয়ে, সাধারণ মানুষের দুর্দশা নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তাও কিন্তু কম হত না।'
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নিশ্চয়ই একটি ছবি তাঁর থেকে উপহার পেত দর্শক? লকডাউন নিয়ে, দুঃসময় নিয়ে? 'অশনি সংকেত ২' হত কী? সেই ছবিতেও তো...এবার থামিয়ে দিয়ে, 'এটা আমার থেকে বাবু ভালো বলতে পারবে। তুমি বরং ওঁকে জিজ্ঞাসা কর' ঝটিতি উত্তর ললিতার।
বেশ, তাহলে বউমার চোখে শ্বশুরমশাই সত্যজিৎ রায়? বাবা-মেয়ের সম্পর্ক নাকি এখানেও অলিখিত দূরত্ব জন্ম নিয়েছিল ব্যক্তিত্বের ছটায়? হিয়া নস্টাল হতেই গলা আরও নরম। স্মৃতির পড়ন্ত বেলার ছায়া সরাতে সরাতে অতীতে আকণ্ঠ ডুব দেওয়া কণ্ঠ বলল, 'না, না! এক্কেবারেই কঠিন-কঠোর ছিলেন না। আমি খুব কম সময় পেয়েছি ওঁকে। কিন্তু যতদিন পেয়েছি, অফুরন্ত স্নেহ-ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। সবাই বলেন, কঠোর তিনি। আমি কিন্তু উল্টোটাই জানি। নিজে নাতির নাম রেখেছিলেন সৌরদীপ। চার প্রজন্মের নামের আদ্যাক্ষর 'স' দিয়ে।'
করোনা কাড়ল প্রবাসী ভাইকে, দুই দেশের সেতুবন্ধন 'অ্যাপেল ট্রি'
একটা সময় ২ মে সত্যজিৎ রায়ের বৈঠকখানা গমগম করত লোকের ভিড়ে। সাধারণ থেকে অ-সাধারণ---সবার জন্য এদিন অবারিত দ্বার রায় বাড়ি। অতিথি আপ্যায়নের জন্য বড় বড় থালায় রাখা থাকত জিলিপি, সিঙারা, খাস্তা কচুরি। যতদিন ছিলেন ততদিনই কি এভাবেই জন্মদিন পালন হত তাঁর? অল্প থেমেই ফিরতি জবাব, 'আমি কোনোদিন এমনটা দেখিনি। বাবার হার্ট অ্যাটাকের পর থেকে ডাক্তারবাবুরা এ বাড়িতে লকডাউনের নির্দেশ দিয়েছিলেন (হাসি)। এত ভিড়, এত হইচই বাবার অসুস্থ শরীর নিতে পারবে না বলে। তাই হৃদরোগের পর থেকেই রায় বাড়ি এই দিনের আগে থেকেই বাইরে চলে যেত। হয় আমরা কাঠমাণ্ডুতে কাটিয়েছি। নয় বাবা হোটেলে চলে যেতেন। সম্ভবত শেষ জন্মদিন কাটিয়েছেন তাজ বেঙ্গলে। একবার ছিলেন কেনিলবার্গে। এভাবেই যতদিন বেঁচেছিলেন, জন্মদিনে ভ্রাম্যমাণ সত্যজিৎ রায়।'
নিজের হাতে কোনও বিশেষ পদও তাই রেঁধে খাওয়ানো হয়নি বউমার। শ্বশুরমশাইয়ের এমন বিশেষ দিনেও।