বিজেপি মাতাল ডিগারের ছবি ও তাঁর পরিবার। তিনি ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে নিহত হন।
হাইলাইটস
- দেখা গিয়েছে কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ সত্যি নয়।
- কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রমাণ কিছুই নেই।
- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বাংলায় কোনও রাজনৈতিক খুন হয়নি।
কলকাতা/ নয়াদিল্লি: তৃণমূলের (TMC) হাতে এযাবৎ রাজ্যে নিহত হয়েছেন ৫৪ জন বিজেপি (BJP) কর্মী— বিজেপির (BJP) এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেখা গিয়েছে সাতটি ক্ষেত্রে অভিযোগ মিথ্যে এবং ন'টি ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা কঠিন। NDTV-র একটি তদন্ত থেকে এমনই তথ্য জানা গিয়েছে। গত মাসের শেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর (Narendra Modi) শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বিজেপির দাবি অনুযায়ী গত ছ'বছরে তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে নিহত ৫৪ জন বিজেপি কর্মীর পরিবারকে। তারা ওই ৫৪ জনের নামের একটি তালিকাও প্রকাশ করেছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রে তৃণমূলের জড়িত থাকার বিবরণ সহ। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের রাজ্যে কোনও রাজনৈতিক খুন হয়নি।
“দেশদ্রোহীর” মতো কাজ করছেন মমতা
মমতার দলের তরফেও একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে বিজেপির তালিকার ৫৪ জনের মধ্যে আট জনের নাম উল্লেখ করে দাবি জানানো হয় এঁদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে অভিযোগ একেবারেই ‘মিথ্যে'। দল বলে, ওই আটটি মৃত্যুর কোনওটিই রাজনৈতিক হত্যা নয়। এবং মৃত্যুর আসল কারণও দেখানো হয়। বলা হয় দুর্ঘটনা, হৃদরোগ, অতিরিক্ত মদ্যপান এই সব কারণে ওই মৃত্যুগুলি হয়েছে। NDTV বিজেপির তালিকার ৫৪ জনের মধ্যে ২৩টি ক্ষেত্রে দিল্লিতে আসা পরিবারগুলির সঙ্গে দেখা করা, পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া, পরিবারগুলির সঙ্গে বা ঘটনার সাক্ষীর সঙ্গে কথা বলা, পুলিশ ও হাসপাতালের নথি খুঁটিয়ে দেখার মাধ্যমে সত্য খুঁজে দেখেছে।
‘ক্ষমতাহীন' বলে নীতি আয়োগের বৈঠকে যাবেন না মমতা, চিঠি লিখলেন মোদীকে
ওই ২৩টি মৃত্যুর মধ্যে সাতটির ক্ষেত্রে, বলা যায় পরীক্ষিত ঘটনার ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে তৃণমূলের দ্বারা বিজেপি কর্মী খুনের অভিযোগ মিথ্যে, কেননা প্রমাণ থেকে তৃণমূলের যোগের কোনও সূত্র মিলছে না। কোনও ক্ষেত্রে পরিবারগুলিই তৃণমূলের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করা হয়েছে, অথবা নিহত ব্যক্তি কোনও ধর্মীয় দাঙ্গা বা দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। কিংবা ময়না তদন্তের রিপোর্ট বলছে মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা।
বীরভূমের ২৮ বছরের বিজেপি কর্মী লাল্টু দাস ২০১৮ সালে গাড়ি চাপা পড়ে মারা যান। তাঁকে তাড়া করেছিল পুলিশ, কেননা তিনি ‘জয় শ্রী রাম' লেখা পতাকা সাইকেলে লাগিয়ে ঘুরছিলেন। এমনটাই জানিয়েছে বিজেপি। তাঁর পরিবার দায়ী করছে পুলিশকে। কিন্তু তারপর স্থানীয় বিজেপি কর্মীর জোরাজুরির পরে তাঁরা তৃণমূলের নাম করেন।
কিন্তু ময়না তদন্তের রিপোর্ট বলছে মৃত্যু হয়েছে পথ দুর্ঘটনায়। এমনকী, এফআইআরেও তৃণমূলের নাম নেই। বলা হয়েছে, গ্রামের ভোটের মনোনয়ন পেশের সময় লাল্টু দাসকে ধরা হয়। পুলিশ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করছিল। তখনই তিনি পালাতে যান। এবং ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ হারান।
এছাড়াও যে সব ক্ষেত্রে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে বলে ধরা যাচ্ছে, তাদের অন্যতম বাঁকুড়ার অজিত ঘোষের মৃত্যু। তিনিও ২০১৮ সালের মে মাসে দুর্ঘটনায় মারা যান। তাঁর পরিবারের দাবি, এই মৃত্যুর সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক যোগসূত্র নেই। উত্তর দিনাজপুরের টোটন দাস ও বসিরহাটের কার্তিক ঘোষ ধর্মীয় সংঘর্ষে মারা যান ২০১৭ সালে। এমনটাই দাবি তাঁদের পরিবারের। পুরুলিয়ার শিশুপাল সাহিস এবছরের এপ্রিল মাসে মারা গেলে ময়না তদন্তে মৃত্যুর কারণ জানানো হয়েছিল আত্মহত্যা। পুরুলিয়ার জগন্নাথ টুডু গত বছরের মে মাসে পথ দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। সত্যি অভিযোগপত্রে তৃণমূলের নাম নেওয়া হয়নি। এই পাঁচটি ক্ষেত্রেই বিজেপি তৃণমূলকে দায়ী করেছে।
সাতটি কেসে যদিও পরিবারের দাবি, পুলিশ নথি ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সত্যের পক্ষেই রায় দিচ্ছে।
বিজেপির বিজয় মিছিলে ‘না' রাজ্য প্রশাসনের
ঝাড়গ্রামের মাতাল ডিগার, ৪২ বছরের বিজেপি কর্মী, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে নিহত হন। বিজেপির মতে, তাঁকে তৃণমূলের হাতে প্রহৃত হতে হয়েছিল। সেই চোটের কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়। যদিও তৃণমূলের দাবি, এক অপহৃত ব্যক্তি শান্তনু পাত্রকে মুক্ত করার ব্যাপারে দরাদরি করতে দিয়েই তিনি প্রহৃত হন। মাতাল ডিগারের পরিবারের দাবি, ওই অপহরণের সঙ্গে তৃণমূলের যোগ ছিল।
মাতাল ডিগারের ভাগ্নে সঞ্জয় ডিগার জানান, ‘‘শান্তনু পাত্রকে তৃণমূলের লোকেরা অপহরণ করেছিল। মাতাল ডিগার ওখানে (তৃণমূল অফিস) গিয়েছিল শান্তির সঙ্গে শান্তনুকে ছাড়িয়ে আনতে। কিন্তু ওরা তাঁকেই আক্রমণ করে। পাত্র বিজেপি কর্মী ছিলেন।'' তাঁর ভাই, গয়াপ্রসাদ ডিগার জানান, তিনি সেই মুহূর্তে মাতাল ডিগারের সঙ্গে ছিলেন যখন তাঁকে আক্রমণ করা হয়। তিনিও তৃণমূলকেই দায়ী করছেন। স্থানীয় পুলিশ আধিকারিক, যিনি ওই ঘটনাটি জানতেন, তিনি বললেন, অন্তত দুই থেকে চারজন যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তারা তৃণমূলেরই কর্মী।
জয়ে ফিরতে জগন্ময় রেড্ডিকে বিপুল জয় এনে দেওয়া প্রশান্ত কিশোরের হাত ধরলেন মমতা
একই ভাবে নদিয়ার বিপ্লব শিকদারকে গত মে মাসে পরিবারের সামনেই গুলি করে মারার ক্ষেত্রেও তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তির কথা জানিয়েছে তাঁর পরিবার।
আসল পুলিশ অভিযোগপত্রে তৃণমূলের নাম ছিল। জয়দেব পান্টির ভাগ্নে দাবি, তিনি দেখেছেন তৃণমূলের লোকেরাই তাঁর মামাকে হত্যা করেছে। অভিযুক্তরা তারাই, যাদের রাজ্যের শাসক দলও অভিযুক্ত করেছিল।
বাকি ন'টি কেসের ক্ষেত্রে (৩৯ শতাংশ) তৃণমূলের জড়িত থাকার কোনও অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যেমন, পুরুলিয়ার ২০ বছরের তরুণ ত্রিলোচন মাহাতোকে গাছ থেকে ঝুলতে দেখা যায় মে ২০১৮-তে। বিজেপি এবং তাঁর পরিবারের দাবি তৃণমূলই তাঁর হত্যায় অভিযুক্ত। কিন্তু তাঁর পরিবার NDTV-কে জানিয়েছে, তাঁদের দাবির পক্ষে কোনও প্রমাণ বা সাক্ষ্যপ্রমাণ মেলেনি।
‘মন শুদ্ধ করতে' মমতাকে রামচরিত মানস উপহার দিলেন বারাণসীর পুরোহিত
পশ্চিম মেদিনীপুরের সুখদেব মাহাতো যিনি ২০১৮ সালের মে মাসে মারা যান, তাঁর মৃত্যুর জন্য বিজেপি তৃণমূলকেই দায়ী করেছিল। কিন্তু সেভাবে প্রমাণ মেলেনি। তাঁর পরিবারের দাবি, তৃণমূল তাঁকে আগেই হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু এছাড়া আর কোনও প্রমাণ তাঁরা পাননি।
এবারের নির্বাচনে দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রে বিজেপির লোকসভা প্রার্থী চন্দ্রকুমার বসু NDTV-কে বলেন, বিজেপি ওই ৫৪ জনের তালিকা তৈরি করেছে ‘তদন্ত' করেই।
তিনি বলেন, ‘‘যে তালিকা আমরা দিয়েছি তা প্রমাণের উপর ভিত্তি করেই তৈরি। আমরা এমনি এমনি একটা তালিকা তৈরি করে দিইনি। আমরা তদন্ত করেছি। পরিবারগুলির সঙ্গে কথা বলেছি। এবং তারপর তালিকাটি তৈরি হয়েছে... শেষ রায় অবশ্য আদালত দেবে।'' তিনি জানান, এই খুনগুলির ক্ষেত্রে, বিশেষত একটি ক্ষেত্রে, যেখানে প্রমাণ মিলেছে, তদন্তের ভার সিবিআই-এর উপরে।