কলকাতা: এক এক্কে এক
পুরুষের অধিকার নিয়ে কাজ করা এক সংগঠনের কর্ণধার বলছিলেন, “হেতাল পারেখকে দেখেছেন? কি বিচ্ছিরি যে দেখতে! ওকে কে রেপ করতে যাবে?”
দুই এক্কে দুই
মুর্শিদাবাদের একটি ছোট্ট শহরের কো-এড ইস্কুলে টিফিনের ঘণ্টা পড়লেই হকারদের থেকে টিফিন কেনার হুড়োহুড়ি। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেয়েরা বেরোতে পারবে না, দরজায় তালা ঝুলিয়ে প্রধানশিক্ষক বলেছেন, “অবসর সময়ে মেয়েরা ছেলেরা একসাথে মিশলে সমস্যা আছে।” কেন ছেলেদের তালা দিয়ে রেখে উল্টোটা করা হল না? উত্তর নেই।
তিন এক্কে তিন
প্রথম সারির পত্রিকায় করিনা কাপুর, সানিয়া মির্জার ইন্টারভিউ। করিনাকে প্রশ্ন, “বিয়ের পরেও কি সিনেমা করবেন?” সানিয়াকে প্রশ্ন, “মা হচ্ছেন কবে?” কেন সইফকে জিজ্ঞেস করা হয় না বিয়ের পর সিনেমা করাটা তার কাছেও আদৌ ‘অপশন' কিনা! মা হওয়া যদি বাধ্যতামূলক হয় তবে শোয়েব মালিকের বাবা হওয়াটা কেন বাধ্যতার আওতায় পড়ে না?
International Women's Day 2019: জেনে নিন বিশেষ দিনের ইতিহাস
চার পাঁচ ছয় করে এমন হাজারো উদাহরণ নিয়ত পাবেন যার প্রত্যেকটিই বাস্তব। প্রতিবছর নারী দিবস (International Women's Day 2019) এলেই অর্ধেক আকাশ শব্দটার প্রতি মোহ কাজ করে হয়ত। সোশ্যাল মিডিয়া ভর্তি পোস্টের মধ্যে দিয়ে আমরা জাহির করতে চাই আন্তর্জাতিক নারী দিবস মানেই উল্লাসের দিন, আসলে বুঝি না কীভাবে শারীরিক সৌন্দর্য, লিঙ্গভেদ, বিয়ে এবং মাতৃত্বের বাধ্যতা ছাড়া ওই অর্ধেক আকাশে আর কিছুই নেই। একদলকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, সমাজ এখন অনেক এগিয়ে গেছে। এখন আর আগের মতো লিঙ্গবৈষম্য নেই। মেয়েরাও তো চাকরি করছে। যেন মেয়েদের চাকরি করার কোনও কথাই ছিল না। করছে মানেই সব সমস্যা মিটে গিয়েছে। আবার অনেক চাকুরিরতার মুখেই শুনি, “আমার শ্বশুরবাড়ি খুবই লিবারাল, আমাকে চাকরি করতে দেয়, জিন্স পরতে দেয়।” আসলে বুঝিই না, পরতে দেয়, করতে দেয়- এসব উচ্চারণের মধ্যেই মালিক আর ভৃত্যের সূক্ষ্ম রাজনীতি লুকিয়ে রয়েছে। পাইয়ে দেওয়া স্বাধীনতা, পাইয়ে দেওয়া অধিকারবোধের মতো ছদ্ম ঘাতক কিছুই নেই।
কোথাও কোনও বিয়েবাড়িতে কোনও পুরুষকে গোলাপফুল দিয়ে অতিথিদের সম্মান জানাতে দেখা যায় না তেমন। ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনও মহিলা কসাই দেখা যায় না, মহিলা পুরোহিতও না। বাসন মাজা, কাপড় কাচার বিজ্ঞাপনে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনও পুরুষ চরিত্র নেই। ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই বিয়ের বিজ্ঞাপনে ঘরোয়া পাত্র চাই লেখা চোখেও পড়েনি। আবার “ওসব মেয়েছেলের কাজ”- জাতীয় অবজ্ঞা বাক্যও রোজই এপাশ ওপাশ ফিরলেই শোনা যায়। সুতরাং লিঙ্গবৈষম্য এখন আর ততটা নেই বলে যারা নিজেদের সান্ত্বনা দিতে চান তাদের কাছেই প্রশ্ন রয়ে যায়, সমস্যা নেই নাকি সমস্যাকে চিনতে ভুল হয় আজও?
নারী দিবসে দেশের রাজনীতিতে মহিলাদের ইতিহাস নিয়ে কংগ্রেসের ক্যুইজ, পুরস্কার ১০ হাজার
সমস্যা শুরু হয় একটি শিশুকে মানুষ করার সময় থেকেই। মানুষ করা হয় না, হয় পুরুষ হয় সে, বা নারী। কোন এক অজানা রোগাভ্যাস থেকে মেয়ে সন্তানের জন্য রান্না-বাটি আর বার্বিডল ছাড়া উপহার আমাদের মনেই পড়ে না। ছেলের বেলায় গতিময় গাড়ি আর খেলনা বন্দুক ছাড়া কিছু ভাবতেই পারি না। শিশুকন্যাটি শেখে, ‘বর আসবে এখুনি, নিয়ে যাবে তখুনি।‘ আর শিশু খোকাটি জানে, বীরপুরুষ হওয়াই ভবিতব্য। ছোট থেকেই, খুকু যাবে শ্বশুরবাড়ি, বর আসবে এখুনি আর হাঁটুর নীচে দুলছে খুকুর গোছা ভরা চুলের সৌন্দর্যের প্রতি কন্যাটির অলীক মোহ তৈরি করা হয়। আমরা সন্তানকে পড়ে শোনাই, অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা কেমন এক কে সাথ এক ফ্রি মালের মতো গছিয়ে দেওয়ার অভ্যাস আমাদের মজ্জায়। সুতরাং এই শিশু কন্যা বড় হলে কন্যাশ্রীর টাকা যে আদতে মেয়ের বিয়ের জন্যই জমানো হবে এমন তো অলিখিত নিয়মই বলা যায়।
গতর খাটানো কাজে এখনও নারীর মজুরি পুরুষের চেয়ে কমই। আমাদের মেয়েদের শেখানো হল ধর্ষণ মানে আসলে ইজ্জত বা সম্মান চলে যাওয়া। ইজ্জত কিনা তাঁর শিক্ষা, চেতনা-জ্ঞান কোথাও না থেকে কেবল যোনিতেই থাকে। থাকে বলেই রড ঢুকিয়ে ভাঙা মদের বোতল ঢুকিয়ে উল্লাস চলে, নারী দিবস তো উল্লাসেরই দিন। কর্পোরেট আমাদের জানিয়েছে রিসেপশনের কাজে মেয়েদের ঢালাও সুযোগ আসলে বাজার টানতে শারীরিক সৌন্দর্য বিক্রির কৌশল মাত্র। বড় হয়ে মানতে হল সিঙ্গল মাদার শব্দটা ইন-ফ্যাশন হলেও সমাজের চোখ পুরুষ-বাবাকে না দেখে তিষ্ঠতে পারে না।
কেন একটা মানুষ ‘অর্ধেক আকাশ পেয়েছি এই না কত'- ভেবে শান্তি পাবে? কেন প্রতিটা মানুষ নিজস্ব আকাশ গড়ার স্বপ্ন দেখবে না? আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারী স্বাধীনতার নয় স্রেফ, দিনটি মানুষের মৌলিক সুস্থ যুক্তির স্বাধীনতার, দিনটি সাম্যের। এমন দিনের স্বপ্নের ধাপ যেদিন ক্রোমোজোমের ভিত্তিতে কাজের এবং বেঁচে থাকার পরিধিকে ছোট করে দেওয়া হবে না। প্রতিটা দিন, প্রতিটা মানুষের সাম্যের হোক, নারী দিবস স্বতন্ত্র আকাশ গড়ার কথা বলুক।
রডে নয়, বরং চিন্তায় শান দিই।