মুক্তোধারায় স্নান করে গোত্র-র খোঁজে নাইজেল আকারা
কলকাতা: সমাজের এই অবজ্ঞা, অবহেলাই তাঁকে ফিরিয়ে এনেছে আলোর পথে। ৯ বছর জেলে বন্দি জীবন কাটানোর পরে চাকরি না পেয়ে নিজের সংস্থা গড়ে, পরিচালক নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-এর (Nandita Roy-Shiboprosad Mukherjee) ‘মুক্তোধারা'য় স্নান করে সেই নাইজেল আকারা (Nigel Akkara) আজ দিকভ্রান্তদের ঘরে ফেরাতে গড়েছেন নাট্য সংস্থা ‘কোলাহল' (Kolahal)। তৃতীয় লিঙ্গ, যৌনকর্মীদের পর যেখানে অভিনয় করছেন নেশামুক্তি কেন্দ্রের হাত ধরে জীবনের পথে ফেরা একদল মানুষ। আগামী নাটক ‘বেওয়ারিশ'-এ (Bewarish)। নতুন নাটকে কী গল্প বলবে নাইজেলের নাট্যসংস্থা? কেনই বা বারেবারে সমাজের তথাকথিত ব্রাত্যদের নিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন উইন্ডোজ প্রোডাকশনের আগামী ছবি ‘গোত্র' (Gotro) র তারেক আলি? রাখঢাক না করেই জীবন উন্মুক্ত করলেন অভিনেতা। ফোনালাপে উপালি মুখোপাধ্যায়
প্রশ্ন: তৃতীয় লিঙ্গ, যৌনকর্মী, নেশামুক্তি কেন্দ্রের সদস্যদের নিয়ে পরপর কাজ কি সমাজের তথাকথিত ব্রাত্যদের প্রতি বিশেষ টান থেকে?
উত্তর: আমি নিজে একসময় ব্রাত্য ছিলাম বলে (হাসি)। তখন মঞ্চ আমায় অনেক কিছু দিয়েছিল। আর যাঁদের সমাজ ভুল পথে যাওয়ার জন্য দূরে সরিয়ে দেয় তাঁদের সমাজে ফিরতে চাই বিশ্বাস, ভালোবাসা। কেউ যেমন ইচ্ছে করে খারাপ হন না তেমনি অনেকে আবার শোধরাতেও চান। কিন্তু সমাজ সাহায্যের হাত বাড়ায় না। ক্রিমিনাল ব্যাকগ্রাউন্ড থাকার জন্য। এখন যাঁদের নিয়ে কাজ করছি তাঁরা মাদকাশক্ত। এঁদের পরিবার নেশামুক্তির জন্য সেন্টারে ভর্তি করে দিয়ে গেছেন। এঁরা নেশার জন্য অনেক খারাপ কাজ করতে পারেন। আবার ভালোবাসা, ভরসা পেলে সব ছেড়ে সমাজের মূল স্রোতে ফিরতেও পারেন। আমি সবাইকে সেদিকে নিয়ে আসার চেষ্টা-ই করছি। থিয়েটার থেরাপির মাধ্যমে। একই সঙ্গে এভাবেই সমাজের বিরুদ্ধে আমার নীরব প্রতিবাদ, সমাজ এদের সুযোগ না দিয়ে ব্রাত্য করে রাখে বলে।
প্রশ্ন: যেভাবে পরিচালক নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদমুখোপাধ্যায় আপনার হাত ধরেছেন? তার আগের পরের আর মাঝখানের জার্নিটা বলবেন?
উত্তর: দিদি-দাদা হাত ধরার আগেই আমি কিন্তু নিজের ব্যবসা খুলে ফেলেছি। তবে এটা একশো ভাগ সত্যি, ওঁরা আমায় নিয়ে মুক্তোধারা না বানালে আমি এত সহজে সমাজে জায়গা পেতাম না। যখন গ্র্যাজুয়েশনে পড়ি তখন একাধিক অপরাধে জড়িয়ে গিয়ে ঠাঁই হয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলে। ওখানে থাকতে থাকতে একটা সময় মনে হয়েছিল. আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব না। কারোর চোখের দিকে চোখ রেখে কথা বলতে পারব না। সেই সময় নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায় প্রেসিডেন্সে জেলে নাচের ওয়াকর্শপ করেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বাল্মিকী প্রতিভা'য় কাজ করেছিলাম। সবাই যখন দেখলাম আমার পারফর্মেন্সের প্রশংসা করছেন, তখনই ঠিক করলাম আর পেছনে ফিরে তাকাব না। ২০০৯-এ মুক্তি পাওয়ার পর মা এসে বলেছিলেন, শহরটা ছেড়ে চলে যাও। এখানে তোমার অনেক খারাপ ঘটনা, অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু আমি জেদ ধরে বলেছিলাম, খারাপ কাজ করেছি এই শহরে। ভালোর স্বীকৃতিও দেবে এই শহর। তখনও দু-টি জামিন যোগ্য মামলা রয়েছে। মাকে একথা বলার পর জামিনে মুক্তি নিয়ে বাইরে আসি। কোনোদিন নিজের অতীত লুকোইনি বলেই দরজায় দরজায় ঘুরেছি চাকরির জন্য। কিন্তু জেল ফেরত আসামীকে কে চাকরি দেবে? ঠিক করলাম, নিজেই ব্যবসা করব। আমার মতোই জেল থেকে বেরিয়ে আসা মানুষদের নিয়ে হাউস ক্লিনিংয়ের সংস্থা খুলি। আমার এজেন্সি লোকের ঘর-বাড়ি-অফিয় এমনকি টয়লেট পরিষ্কারের কাজও করে। এরপরে নন্দিতাদি-শিবুদার সঙ্গে আলাপ। তাঁরা আমায় শিখিয়ে-পরিয়ে নিয়ে ২০১০ 'মুক্তোধারা' করেন। আমায় লোকে চেনে, জানে আরও বেশই করে।
প্রশ্ন: এই জনপ্রিয়তা নাকি জেলের তৎকালীন বাকি বন্দিরা নিতে পারেননি? অনেক বাঁকা মন্তব্য শুনতে হয়েছিল?
উত্তর: (হাসি) হয়েছিল। কোর্টে যখন মামলার শুনানিতে যেতাম অনেকেই বলত, ওকে বসার জন্য সোফা দেওয়া হোক। ওকি আর দাঁড়াতে বা চেয়ারে বসতে পারবে? নাইজেল তো এখন সেলেব্রিটি! আসলে কি জানেন, আপনি যখন স্ট্রাগল করবেন, তখন লোকে বাহবা দেবে। যেই সফল হবেন লোকে আর নিতে পারবে না। হিংসে করবে। সব দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, আর অভিনয় করব না। আরও আছে। অভিজিৎ দাশগুপ্ত একটি ড্যকু ফিল্ম বানিয়েছিলেন আমার ওপর দ্য জেল বলে। তার জন্য আমি অনেক কলেজ, ইনস্টিটিউটে যেতাম ইন্টারাকসেশনে। আমি তো নিজেকে কোনোদিন লুকোয়নি। তারপরেও লোকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে আমায় নিয়ে বড্ডা কাটাছেঁড়া করত। এমন ভাবে দেখত যেন চোখ দিয়েই ধর্ষণ করছে! খুব কষ্ট হত। আমিও তো রক্তমাংসের মানুষ! পরে বুঝেছি, মানুষকে, সমাজকে আমাকে গ্রহণ করার জন্য সময় দিতে হবে। একবার ভুল করলে তার মাশুল গুণতে হয় অনেকদিন পর্যন্ত।
প্রশ্ন: হতাশ হয়ে গেছিলেন?
উত্তর: কোনোদিন হতাশ হইনি। তবে কয়েক পা পিছিয়ে গেছিলাম। বাঘ বা সিংহ যখন শিকারের ওপর ঝাঁপ দেয়, তখন কয়েক পা পিছিয়ে যায়, দেখেছেন তো! নিশানা ঠিক রাখার জন্য। আমিও সেই কারণেই নিজেকে সাময়িক গুটিয়ে নিয়েছিলাম। যাতে আর না ভুল না করি।
প্রশ্ন: এই ধৈর্য, এই লড়াকু মানসিকতার পেছনে কার অনুপ্রেরণা ছিল?
উত্তর: আমার মা। ৯টা বছর আমার থেকেও বেশি কষ্ট পেতে হয়েছে মাকে। তাঁকে সমাজ তখন প্রায় ব্রাত্য করে দিয়েছিল। রাত-বিরেতে একা উকিলের কাছে দৌড়োতে হত আমার জন্য। রাত দেড়টার সময় পুলিশ থানায় তুলে নিয়ে গেছে মাকে। এতোর পরেও মা সাহস, ধৈর্য কোনোটাই হারাননি। তখন মনে হয়েছে, মা পারলে আমি পারব না!
প্রশ্ন: নাট্য সংস্থা গড়ার পেছনেও ইতিহাস নিশ্চয়ই রয়েছে? খুব ভালোবাসেন মঞ্চ?
উত্তর: আমার শুরু তো মঞ্চ দিয়েই। মঞ্চ আমায় অনেক দিয়েছে। নিজের প্রতি হারানো বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে। সাধারণের মুখোমুখি হওয়ার সাহস দিয়েছে। যদিও নাট্য সংস্থা খোলার আগে বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি, আমি আদৌ এসবের যোগ্য তো! আমার তো একটা কালো অধ্যায় আছে। পরে মনে হয়েছে, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে গেলে থিয়েটার থেরাপি সবথেকে ভালো কাজ। নাটক ছাড়া, শিল্পের অন্যদিক ছুঁয়ে দেখারও ইচ্ছে আছে। সম্প্রতি, ঝাড়গ্রামে গেছিলাম। ওখানকার আদিবাসীদের সংস্কৃতি ছুঁয়ে গেছে আমায়। লোক গান নিয়ে ওদের সঙ্গে কাজ করার কথা চলছে। তবে এখনও কিছু ঠিক হয়নি।
অডিশনে সিলেক্ট হওয়ার পরে হাঁটু কাঁপছিল: অঙ্কিতা ভট্টাচার্য
প্রশ্ন: সাত বছর পরে আবার নন্দিতাদি-শিবপ্রসাদদার 'গোত্র' ছবির মুখ্য ভূমিকায়...। মানালির সঙ্গে আপনার কেমিস্ট্রি ট্রেলারেই সুন্দর ভাবে ফুটেছে।
উত্তর: নন্দিতাদি ডেকে বলেন, গোত্র ছবিতে তারেক আলির ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে। তবে তারেক আলি কিন্তু মুক্তোধারা-র ইউসুফ নয়। গোবিন্দধামে কয়েকদিনের ওয়ার্কশপের পরেই শুট শুরু হয়। শিবুদাদের সঙ্গে কাজ করা তো আমার কাছে আশীর্বাদের মতো। আর শিবুদার মায়ের কাছে কেয়ারটেকারের কাজের লোক পাঠিয়েছিলাম আমি-ই। ফলে, আমাকেই ওঁরা ওই চরিত্রের জন্য যোগ্য মনে করেন। অনেকেই আমার আর মানালির কেমিস্ট্রির প্রশংসা করেছেন। আসলে মানালি এমন একজন মানুষ যিনি যখন যেখানে থাকেন সেই জায়গা মাতিয়ে রাখেন। ওয়র্কশপ করতে করতে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। এটা মনে হয় থেকেই যাবে।
প্রশ্ন: ছবিতে আপনার হাতের ওপর দাঁড়িয়ে মানালি ফুল পাড়ছেন, এমন দৃশ্য আছে। মানালি সেই দৃশ্য কোট করে বলেছেন বাংলার অমিতাভ-জয়া বচ্চন। আপনারও কি তাই মত? সেই জন্যএই কি সব ছবিতেই রাগী ইমেজ?
উত্তর: কথাটা মানালি মন্দ বলেননি। বাংলা ছবিতে এই আমার আর মানালির হাইটের পার্থক্য যতটা এমন আর কোনও জুটি চোখে পড়েনি। আমরা যদি বাংলার অমিতাভ-জয়া হই-ই খারাপ কি! তার থেকেও বড় কথা, এই ঝুঁকিটা দিদি-দাদা নিতে পেরেছেন। এটাই মূল কথা। আর বিশেষ কোনো ইমেজ নয়, সব ধরনের চরিত্র করতে চাই। নিশ্চয়ই আগামী দিনে দেখতে পাবেন।
প্রশ্ন: আগামী নাটক বেওয়ারিশ-এর গল্প বলবেন?
উত্তর: ব্যঙ্গের মোড়কে রাজনৈতিক গল্প। ছ-জন বেওয়ারিশ লাশের গল্প। যাদের ঠাঁই হয়েছে মর্গে। কিন্তু কেউ শনাক্ত করেনি। আর তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে যাতে তাদের সনাক্তকরণ করা হয়। কারণ, তাহলেই তাদের অন্ত্যেষ্টি হবে। মোক্ষ লাভ হবে তাদের। আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে এদের মাধ্যমেই। এই নিয়ে কোলাহলের এটি তৃতীয় নাটক। অল্যান রিহ্যাবিলিটেশনের কিছু মানুষ এই নাটকে অভিনয় করেছেন। পরিচালনায় অভিজিৎ অনুকামীন। চিত্রনাট্য মলয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সজ্জায় অনুপম চট্টোপাধ্যায়। উপস্থাপনায় আমি (হাসি)। সবাইকে নিয়ে কয়েকবার ওয়ার্কশপও করেছি। নাটকে গানও ব্যবহৃত হয়েছে সুন্দর ভাবে।রাজ্যের ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিটি ভীষণ ভাবে সাপোর্ট করেছে আমাদের। ২ অগাস্ট বেহালা শরৎ সদনে প্রথম মঞ্চস্থ হবে নাটক। এরপর ১৫ অগাস্ট তপন থিয়েটারে আবার আমরা অভিনয় করব।
প্রশ্ন: সমাজের এই প্রান্তজনদের নিয়ে কাজ করার তো অনেক অসুবিধে?
উত্তর: অবশ্যই। যৌনকর্মীরা তো প্রথমে রাজিই হচ্ছিলেন না। বলছিলেন, এতে কি আমাদের পেট ভরবে? তার চেয়ে রাস্তায় কাস্টমার ধরা অনেক বেশি লাভের। তাদের বোঝাতে হয়েছে, এই ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারলে মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যাবে। দুর্বার সমিতির সাহায্য নিতে হয়েছে। আস্তে আস্তে সমাজের মূল স্রোতে ফিরতে পারবেন তাঁরাও। তাঁদেরকে রবীন্দ্রনাথ বোঝানো-ও খুবই কষ্টের। তবে ওঁদের নিয়ে ঝরাফুলের রূপকথা দর্শক, সমালোচকের প্রশংসা পেয়েছে। একই ভাবে ড্রাগ অ্যাডিক্টদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এমনও হয়েছে কিছুদিন কাজ করে ওঁদের কেউ কেউ হয়ত নেশআ না করার ফলে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ পালিয়ে গেছেন নেশআ করতে। আবার সবাইকে ধরে-বেঁধে এনে কাজ করেছি। অনেকে আবার কাজ করতে করতে একটাই গভীরে ঢুকে গেছেন নাটকের যে পরে বলেছেন, যেন নতুন জীবনের স্বাদ পাচ্ছেন।
প্রশ্ন: ব্রাত্যজন থেকে নাইজেল আকারা অনেক মাশুল গুণে তারকা। পিছনে ফিরে দেখলে আপশোস হয়? মনে হয়, ভুল না করলে এত মাশুল গুণতে হত না?
উত্তর: অবশ্যই এক এক সময় মনে হয়, আরেকবার সুযোগ পেলে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারলে ভুলগুলো শুধরে নিতাম। সঙ্গে এটাও মনে হয়, এই ফেজটা না কাটালে জীবনটাকে ভালো করে চিনে হত না। তাই সব জায়গাতেই আমি বলি, আমার দুই জায়গার পড়ুয়া, কলেজ আর প্রেসিডেন্সি। জেল শব্দটা ব্যবহার করি না। তবে ওর থেকে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর হয় না বোধহয়।
প্রশ্ন: নেতিবাচকের মধ্যেও ইতিবাচক, স্ত্রী সব জেনেবুঝে আপনাকে জীবনসঙ্গী বেছেছেন...
উত্তর: একদম। সারাক্ষণ সাহস জুগিয়েছে। আমার হয়ে নিজের পরিবারের সঙ্গে লড়েছে। ওর বাড়ির লোক যখন আমায় নিয়ে নেটিবাচক আলোচনা করেছেন, ও তাঁদের থামিয়ে দিয়েছে। আমাকে বাড়ির সবার কাছে তুলে ধরে জায়গা করে দেওয়ার পর আমি শ্বশুরবাড়িতে যখন পা রেখেছি, অলরেডি তাঁরা আমায় 'জামাই' বলে মেনে নিয়েছেন! সব ঝাপটা তো ও একাই সামলেছে। এমন সঙ্গী ক-জনের ভাগ্যে জোটে?