নাচের ছন্দে সায়ন্তনী ঘোষ মেঘ (সৌজন্যে: সায়ন্তনী ঘোষ মেঘ)
কলকাতা: অন্তরে রাধা হয়েও তিনি বহিরাঙ্গে পুরুষ। রাধা হতে না পারার সেই যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খেত বয়ঃসন্ধি থেকেই। বড় হয়ে নিজের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে এবং পরিবারের সঙ্গে লড়াই করে ধাপে ধাপে তিনি হয়ে ওঠেন অর্ধনারীশ্বর থেকে সম্পূর্ণ মানবী। স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটতে কাটতেই তিনি, সায়ন্তনী ঘোষ মেঘ (Sayantani Ghosh Megh) রাজ্যের প্রথম রূপান্তরকামী (Transgender) মহিলা আইনজীবী। একই সঙ্গে সমাজের বাকি তৃতীয় লিঙ্গদের সম্মান এনে দিতে গড়ে তুলেছেন রুদ্রপলাশ (Rudra Polash) নৃত্য একাডেমি। প্রশ্নোত্তরে উঠে এল জীবনভর সংগ্রামের গল্প। যা আজও যেন শেষ হইয়াও হইল না শেষ। পদবীর শেষে কেন মেঘ শব্দ জুড়েছেন? জেনে নিলেন উপালি মুখোপাধ্যায়
প্রশ্ন: প্রথম কবে বুঝলেন আপনি অন্যদের থেকে আলাদা?
উত্তর: প্রথমেই বলি, তৃতীয় লিঙ্গ কিন্তু আগেও সমাজে ছিল। এখনও আছেন। আগে এঁদের বলা হত অর্ধনারীশ্বর। আমরা আলাদা শরীরে বা মনে। সমাজের থেকে আলাদা নই। জন্মেছি আমি পুরুষের শরীর নিয়ে। ছোটবেলা থেকে তো কিছুই বোঝা যায় না। বুঝলাম, বয়সন্ধির সময়। তখন থেকেই লড়াই শুরু স্রোতের বিরুদ্ধে।
প্রশ্ন: মা-বাবা নিশ্চয়ই ভেঙে পড়েছিলেন? আপনি?
উত্তর: মায়ের খুব কষ্ট হয়েছিল। আমি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম স্বাভাবিক ভাবেই। তবে মা-ই কিন্তু পরে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছেন আমায়। সেই থেকে নিরন্তর লড়াই চলছে আজও। মায়ের জোরেই আমি স্কুলের পাঠ চুকিয়ে কলেজ গেছি। আইন নিয়ে পড়েছি। হাইকোর্টে গেছি। নাচের দল রুদ্র পলাশ খুলেছি। ছেলের শরীর বদলে সম্পূর্ণ নারী হয়েছি।
প্রশ্ন: প্রথম যখন আইনজীবী হিসেবে কোর্টে দাঁড়ালেন কেমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল?
উত্তর: ২০১৩-য় প্রথম রূপান্তরকামী মহিলা আইনজীবী হিসেবে কোর্টে পা রাখি। কিন্তু পা দিতেই এমন মর্মান্তিক ব্যবহার পেয়েছিলাম সবার থেকে যে, ওই বছরেই আদালত চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে আসি। তারপরেই নাচের দল খুলি রুদ্র পলাশ। যার মধ্যে দিয়ে আমার কথা, আমার মতো বাকিদের কথা বলব বলে ঠিক করি। এর বেশ কয়েকবছর পরে আমি আবার পা রাখই আদালতে। তখন আর ততটাও খারাপ অনুভূতি হয়নি। আমার সিনিয়ার স্যারও যথেষ্ট সাহায্য করেছেন এব্যাপারে। আমার ক্লায়েন্টরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
প্রশ্ন: আইনের কোনদিকটায় রয়েছেন?
উত্তর: ক্রাইমের দিকে। বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করেছি।
প্রশ্ন: এত বিষয় থাকতে আইন নিয়ে পড়লেন কেন? বিশেষ করে ক্রিমিনাল ল-এর মতো বিষয় নিয়ে?
উত্তর: মনে হয়েছিল আগামী দিনে লড়াই চালাতে গেলে আমার পায়ের তলার মাটিকে আরও শক্ত করা দরকার। তার জন্যেই আইনকে বেছেছি। আর অপরাধ দুনিয়ার মানুষদের জীবন নিয়ে, তাদের অপরাধমনস্কতা নিয়ে আমার জানার ইচ্ছে প্রবল। সেই ইচ্ছে থেকেই ক্রিমিনাল ল নিয়ে পড়াশোনা করা।
প্রশ্ন: অপরাধ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কখনও মনের ওপরে তার প্রভাব পড়েনি? অপরাধীদের দেখে খারাপ লাগেনি?
উত্তর: আমি মনে করি, পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়। সেই বিশ্বাস নিয়েই প্রতিটা কেস লড়ি। আর নিজের জীবনের সঙ্গে ওদের জীবন গুলিয়ে যেতে দিই না। তাই হয়ত এখনও সামলাতে পারছি। তবে এক একটা কেস তো ছাপ রেখেই যায়।
প্রশ্ন: রুদ্র পলাশ নিয়ে কিছু বলুন....
উত্তর: রুদ্র পলাশ আমার বেঁচে থাকার রসদ। আমার অক্সিজেন। আমার মতো আর পাঁচজনের লড়াই করে উঠে আসা্র প্ল্যাটফর্ম। ঋতুপর্ণ ঘোষ যে বছরে চলে গেলেন সে বছরে জন্ম রুদ্র পলাশের। ওঁকে সম্মান জানাতে। কারণ, ঋতুদা ষেভাবে আমাদের জন্য লড়েছেন তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। তাই প্রতি বছর ৩১ অগাস্ট রুদ্র পলাশ স্মরণ করে ঋতুদাকে ‘ঋতু উতসব'। সম্মানিত করে কলকাতার প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বদের। যেমন, অলকানন্দা রায়, মীর। থাকে নৃত্যনাট্যও। এবছরেও আমরা সম্মাননা জানাব উইমেন্স কলেজের অধ্যক্ষ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় সহ একগুচ্ছ তারকাদের। এছাড়াও থাকবে, মহাভারত। এখানে নাচের মাধ্যমে তুলে ধরা হবে মহাভারতের সমস্ত নারী চরিত্রকে। অংশ নেবেন আমার মতো আরও তৃতীয় লিঙ্গরা। আমি করছি দ্রৌপদী। আমাকে এই অনুষ্ঠআন করতে এবছর ভষণ ভাবে সাহায্য করছে চারুচন্দ্র কলেজেক এনএসসি বিভাগ।
প্রশ্ন: দ্রৌপদীকে খুব পছন্দ?
উত্তর: দ্রৌপদীর লড়াইকে আমি সম্মান করি। দ্রুপদ রাজার মেয়ে হয়েও পাঁচজন স্বামী তাঁর। ভরা সভায় বস্ত্রহরণ হয়েছে। সেই জায়গা থেকে উঠে বেরিয়ে আসা নিজের জোরে---এটাই আমাকে রোজ লড়াইয়ের প্রেরণা জোগায়। এর অআগে আমি চিত্রাঙ্গদা হয়েছি। লড়াকু চরিত্র আমার খুব পছন্দের।
প্রশ্ন: যখন সব কাজ ফুরিয়ে যায় বা এত কিছু করার পরেও যখন সমাজ, লোকজন বাঁকা নজরে দেখে নিশ্চয়ই অবসাদ আসে? কী করেন তখন?
উত্তর: হ্যাঁ, অবসাদ আসে। মনে হয়, এত লড়াইয়ের পরেও তো পুরোপুরি জিত হল না। তখন গান শুনি। বই পড়ি। আর ওই যে বললাম, রুদ্র পলাশ আমার অক্সিজেন। সেখানে নিজেকে আরও ব্যস্ত রাখি।
প্রশ্নঃ আগামী দিনে কী করার ইচ্ছে আছে?
উত্তর: ট্রান্সজেন্ডার জন্য অনেক কিছু করা বাকি। এখনও ওরা কাজ পায় না। সমাজের চোখে ঘৃণিত, অবহেলিত। সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে হবে ওঁদের।
প্রশ্নঃ শুধুই ওঁদের জন্য করবেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তো ভাবছেন ওঁদের জন্য...
উত্তর: আমি বৃদ্ধাশ্রমের কাজও করেছি। হ্যাঁ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভেবেছেন। করছেনও। ভবিষ্যতেও আরও কিছু করবেন বলে কথা দিয়েছেন। তবে আমারও তো কিছু তাগিদ, দায় থেকে যায়।
প্রশ্নঃ বিয়ে করবেন না?
উত্তর: মনের মতো সঙ্গী পেলে নিশ্চয়ই করব।
প্রশ্নঃ পদবীর শেষে এই মেঘ শব্দটা কেন?
উত্তর: (এবার হাসি), মেঘের কোনও নির্দিষ্ট লিঙ্গ নেই বলে। সে মেয়েও হতে পারে। ছেলেও হতে পারে। হতেই পারে অর্ধনারীশ্বর। কখনও কোনোদিন লিঙ্গের বাঁধনে বাঁধা যায়নি মেঘকে। আমিও যে ঠিক ওইরকমই। মেঘের মতো!
:
Click for more
trending news