গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে অঙ্কিতা (সৌজন্যে: ফেসবুক)
কলকাতা: বাড়ি থেকে বাইরে পা রাখলেই ধেয়ে আসছে একটাই কথা--- ‘ওই দেখ, অঙ্কিতা যাচ্ছে! জি বাংলা সা-রে-গা-মা-পা-র চাম্পিয়ন।' এই স্বপ্ন পূরণ করতেই কি এই মঞ্চে পা রাখা? অ-নে-ক পুরস্কার আর প্রচুর জনপ্রিয়তায় ভাসতে ভাসতে এখনও কি মাটিতেই পা রেখে হাঁটছেন গোবরডাঙার মেয়েটি? ভবিষ্যত জীবন নিয়েই বা কী ভাবছেন ইছাপুর হাই স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী? NDTV-কে অকপটে জানালেন অঙ্কিতা ভট্টাচার্য। জেনে নিলেন উপালি মুখোপাধ্যায়
প্রশ্ন: সা-রে-গা-মা-পা চ্যাম্পিয়ন, ২ লক্ষ টাকার চেক, সোনার গয়না, গাড়ি---- সব মিলিয়ে রাতারাতি সেলিব্রিটি অঙ্কিতা?
উত্তর: এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, আমি চাম্পিয়ান। নাম দিয়েছিলাম ফাইনালে আসার জন্যই। কিন্তু শেষপর্যন্ত পারব, ভাবতে পারিনি। এখনও যেন ঘোরের মধ্যে আছি। তবে সেলিব্রিটি মনে হচ্ছে না নিজেকে। চাই-ও না নিজেকে তেমন কিছু মনে করতে।
প্রশ্ন: ফাইনালের দিন একে হেভি ড্রেস, সঙ্গে সেরা পারফর্ম করার চাপ। পুরোটা সামলালেন কী করে?
উত্তর: আমি সাজতে খুব ভালোবাসি। নিত্য নতুন সাজ দারুণ লাগে। এই দিনের সাজটা আমার খুব ভালো লেগেছিল। সবাই বলছিল, খুব সুন্দর দেখতে লাগছে। সেই আনন্দেই সেরা পারফর্মেন্স করেছি (হাসি)।
প্রশ্ন: বাইরে বেরলেই লোকে চিনতে পারছে? কী বলছে দেখে?
উত্তর: মা-বাবার সঙ্গে ব্যাঙ্কে গেছিলাম। সবাই চিনতে পেরে বলছে, ‘ওই দেখ, অঙ্কিতা যাচ্ছে! জি বাংলা সা-রে-গা-মা-পা-র চাম্পিয়ান। সঙ্গে ওর মা-বাবা।' শুনে খুব ভালো লেগেছে। এটাই তো চেয়েছিলাম।
প্রশ্ন: এত পুরস্কার? জনপ্রিয়তা?
উত্তর: না, চেয়েছিলাম সবাই আমার গান শুনুক। আমাকে ভালোবাসুক। আমাকে চিনুক। তার জন্যেই তো জি বাংলার এই মঞ্চে আসা। আর সেখানে সেরা হওয়ায় আমার দায়িত্ব যেন অনেকটাই বেড়ে গেল। জি বাংলা সা-রে-গা-মা-পা একলাফে অনেকটাই এগিয়ে দিল আমাকে। বাকি পরিশ্রম করে আমায় অর্জন করতে হবে। তবে সব দিক থেকে দু-হাত ভরে দিল এই প্ল্যাটফর্ম। আমি সারা জীবন ঋণী থাকব জি বাংলার কাছে।
গান ভালোবেসে গাইতে এই প্রথম একজোট এই প্রজন্মের শিল্পীরা
প্রশ্ন: কত বছর বয়স থেকে গান শিখছেন? কার কাছে শিখেছেন?
উত্তর: আমি কিন্তু শুরু করেছি নাচ দিয়ে। আমার মা চেয়েছিলেন নাচ শিখব। হঠাৎ করেই সাড়ে চার-পাঁচ বছর বয়স থেকে যখন গান করতে শুরু করি তখন বাবা শুনে গান শিখতে বলেন। সেই থেকে শুরু। আমার মা-ও খুব ভালো সব ধরনের গান গাইতে পারেন। মায়ের কাছেই আমার নাড়া বাঁধা। তারপর বেশ কিছুদিন শিখি রাধামাধব পালের কাছে। গত সাত বছর ধরে শিখছি রথীজিৎ ভট্টাচার্যের কাছে। আমার বাবা খুব ভালো গান বোঝেন। গানের একটু এদিক-ওদিক হলেই ধরিয়ে দেন।
প্রশ্ন: কার ইচ্ছেতে জি বাংলা সা-রে-গা-মা-পা-র মঞ্চে আসা? অডিশনে সিলেক্ট হওয়ার পর কী মনে হল?
উত্তর: মায়ের ইচ্ছেতেই এই প্ল্যাটফর্মে আসা। মা-বাবা দু-জনেই দেখতে চেয়েছিলেন এই মঞ্চে আমি গাইছি। আমার ইচ্ছে তো ছিলই। তবে অডিশনের পর যখন সিলেক্ট হলাম ভয়ে আমার হাঁটু কাঁপছিল। এত বড় মঞ্চে গান গাওয়ার সুযোগ পেলাম। পারব তো এই সুযোগকে কাজে লাগাতে! এটাই মনে হচ্ছিল বারবার।
প্রশ্ন: অনেকগুলো দিন একসঙ্গে কাটালেন বিচারক, প্রশিক্ষক, প্রতিযোগী বন্ধুদের সঙ্গে? দিনগুলো কীভাবে কাটত? কীভাবে গ্রুমিং করা হত?
উত্তর: আমরা একটা পরিবার হয়ে ছিলাম। প্রতিযোগী কম, বন্ধু বেশি। সবাই সবাইকে সাহায্য করতাম। তিন বিচারক শান্তনু মৈত্র, শ্রীকান্ত আচার্য, মোনালি ঠাকুর আলাদা আলাদা করে ভুলগুলো ধরিয়ে দিতেন। ভালো হলে প্রশংসা করতেন। আর স্যারেরাও ভীষণ ভালো ছিলেন। গ্রুমিংয়ের জন্য আলাদা করে কোনও ক্লাস নিতেন না। গান গাওয়ার ওপর জোর দিতেন বেশি। বলতেন, গান ভালো করে অনুভব করতে পারলে আপনা থেকেই পারফর্ম ভালো হবে।
প্রশ্ন: অনেক সময় ভালো পারফর্ম না হলে অডিয়েন্সের সামনেই বিচারকেরা খোলাখুলি বলতেন। খারাপ লাগত? টেনশন হত? বিচারকদের মধ্যে কাকে বেশি ভয় আর বেশি ভালো লাগত?
উত্তর: ওঁরা যেটুকু ভুল করতাম সেটুকুই বলতেন। ওটা আমার কাছে আশীর্বাদ ছিল। নিজেকে শুধরে নিতে পেরেছি তার জন্য। একেবারেই খারাপ লাগা বা টেনশন ছিল না। তবে ভয় আমি সবাইকেই ভী-ষ-ণ ভাবে করতাম। ভাল-ও বাসতাম সবাইকে। ওঁরা কিন্তু পারফর্মের পরে বা শো-এর পরেও আলাদা করে ডেকে বলে বুঝিয়ে দিতেন। বকতেন না একটুও।
প্রশ্ন: ফাইনালে আপনার পাশাপাশি নোবেলের নামও ছিল। অনেক সময় নোবেল যেন অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়ে যেতেন। কখনও মনে হয়েছে প্রচারের আলো কেড়ে নিচ্ছে ও একাই?
উত্তর: এসব একেবারেই ভাবতাম না। এসব ভাবলে গান গাইব কখন? নোবেল নোবেলের মতো ছিল। আমি আমার মতো। আর দিনের শেষে আমরা সবাই ভালো বন্ধু। এটাই শেষ কথা।
প্রশ্ন: ইতিমধ্যেই শ্রেয়া ঘোষালের সঙ্গে আপনার তুলনা হচ্ছে... এটা পুরস্কার? না চাপ বাড়ছে এতে?
উত্তর: শ্রেয়া ঘোষাল আমার প্রথম পছন্দের শিল্পী। আমার আইডল আশা ভোঁসলে। কারণ, উনিও সব ধরনের গান গাইতে পারেন। ভালো পারফর্মারও। আর ভবিষ্যতে যদি শ্রেয়া ঘোষাল হতে পারি তাহলে এর থেকে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে! আমি তো প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হওয়ারই স্বপ্ন দেখি সবসময়।
প্রশ্ন: গান ছাড়া আর কী কী ভালো লাগে?
উত্তর: নাচ তো পারিই। আবৃত্তি পারি। নাটক করেছি ছোটবেলায়। আর আমাদের গ্রামের পাড়ায় দোলের আগের দিন রাধামাধবের পুজো হয়। সেখানে যাত্রা হয়। তাতেও অভিনয় করেছি। শিল্পের সব দিকটাই আমায় টানে।
প্রশ্ন: আর পড়াশোনা?
উত্তর: ওটাই একেবারে ভালো লাগে না। কিন্তু না পড়লে বাড়িতে খুব বকবে। আর্টস নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক দেব আগামী বছরে। অনেকদিন পড়া থেকে দূরে। যদিও স্কুলের স্যার-ম্যামেরা সমস্ত নোট দিয়ে খুবই সাহায্য করছেন। উৎসাহও দিয়েছেন খুব। হেড স্যার অশোক পাল যেভাবে আমার পাশে থেকেছেন সব সময়, কোনোদিন ভুলব না সেটা।
প্রশ্ন: প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার পর স্কুলে গেছিলেন যখন সবাই কী বললেন?
উত্তর: পা রাখতেই হাততালিতে ফেটে পড়ল স্কুল। সব স্যার-ম্যামেরা খুব আদর করলেন। বন্ধুরা আনন্দে জড়িয়ে ধরছিল। স্কুলের ছোট-বড় সবাই কিছু না কিছু উপহার এনেছিল আমার জন্য। কেউ কিনে এনেছিল, কেউ তৈরি করে এনেছিল। একটা ছোট্ট ছেলে কিছু আনতে পারেনি বলে ১০০ টাকার নোট আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, দিদি তুমি এটা দিয়ে কিছু কিনে নিও। তোমার ইচ্ছে মতো। ঠিক করেছি, ওই টাকাটা ল্যামিনেট করে বসার ঘরে বাঁধিয়ে রাখব।
প্রশ্ন: গান 'পাখির চোখ' হলে ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
উত্তর: শো বেশি করব না। কারণ, বেশি গান গাইলে গলা খারাপ হয়ে যায়। ছবির গানের জন্য, অ্যালবাম করার জন্য ডাক পাচ্ছি। ভালো লাগছে। সব ধরনের গান গাইতে চাই। শিখতে চাই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে ওয়েস্টার্ন মিউজিকও। তবেই সব ধরনের গান গাইতে পারব। সঙ্গে অবশ্যই পড়াশোনাটাও চালিয়ে যেতে হবে। আর সবাই আনন্দে ভাসলেও আমি কিন্তু মাটিতেই পা রেখে চলছি। গ্রামের মেয়ে। আমার কাছে মাটি-ই খাঁটি।
প্রশ্ন: টানা ২৬ টা এপিসোডে সেরা পারফর্মার আপনি! এটাই কি অঙ্কিতা-ম্যাজিক ?
উত্তর: (হেসে ফেলে) একেবারেই না। ঈশ্বরের আশীর্বাদ। মা-বাবার ভালোবাসা। দর্শকদের শুভেচ্ছা। আর জি বাংলা সা-রে-গা-মা-পা-র স্যার, বিচারকদের শুভকামনা।