বর্ধমানের কোটালহাটের কালী পরিচিত কমলাকান্তের কালীবাড়ি নামে
কলকাতা: বাঁকা নদীর তীর, ঘন জঙ্গলে ঘেরা, অমামশ্যার মহানিশা, ঘন জঙ্গলের সেই অন্ধকারে গাছের তলায় পঞ্চমুণ্ডির আসনে একাগ্রচিত্ত্বে সাধনায় রত এক মহাসাধক। সামনে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে কালকেউটে। এভাবেই মহাসাধককে পাহারা দেওয়ার পাশাপাশি তাঁর শক্তি, একাগ্রতার পরীক্ষা নিয়েছিলেন স্বয়ং মহাকাল। হঠাৎই সাধকের বুকে এক ছোবল সেই কালকেউটের। তাতেও ধ্যানভঙ্গ হল না সেই মহাসাধকের। মুহুর্তের মধ্যে ঘুচে গেল অন্ধকার। ছিন্ন হল সব মায়াজাল। সামনে খড়গ, মুণ্ডমালা, অভয়মুদ্রা হাতে আবির্ভূতা হলেন সাধকের ইষ্টদেবী মা কালী (Kali Puja 2019)। সিদ্ধিলাভ করে বর্ধমানকে প্রসিদ্ধ করলেন ‘মায়ের কোলের ছেলে' কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (kamalakanta)।
একা নন, দেবী কালীকা চার বোনকে নিয়ে পূজিতা কোথায়?
বর্ধমানের অম্বিকা-কালনা গ্রামে জন্ম হলেও, পরে তিনি চলে আসেন চান্না গ্রামে। অল্প বয়সেই শিক্ষালাভে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন কমলাকান্ত। মুখে মুখে পদ রচনা করতে পারতেন। শান্ত স্বভাবের ভাবুক প্রকৃতির এই মহাসাধক ছোটোবেলা থেকেই মা কালী অন্তপ্রাণ।
বাড়ির পাশে জঙ্গলে ঘেরা বিশালাক্ষী মন্দিরের সংস্কার করে পুজোর ব্যবস্থা করেছিলেন অল্প বয়সেই। সেখানেই চলত তাঁর সাধন-ভজন। দুরন্ত সাহসী কমলাকান্তের ব্যুৎপত্তিতে মুগ্ধ ছিলেন সকলেই। অল্পবয়সেই মাতৃমন্ত্রে দীক্ষিত হন তিনি। পরে কেনারাম চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা করেন কমলাকান্ত।
এভাবেই বাঁকা নদীর পাড়ে শ্মশানে পঞ্চমুণ্ডির আসনে তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন এই মহাসাধক, কবি। তাঁর ক্ষমতায় অভিভূত হয়েছিলেন বর্ধমানের মহারাজ তেজশচন্দ্র বাহাদুর। যাঁকে ঘোর অমাবস্যার রাতে পূর্ণিমার চাঁদ দেখিয়েছিলেন মহাসাধক। কোটালহাটে মন্দির তৈরি করে দিয়ে কমলাকান্তের নিত্যপুজোর ব্যবস্থা করেন মহারাজ। বর্ধমানের কোটালহাটের কালী তাই পরিচিত কমলাকান্তের কালীবাড়ি নামে ( kamalakanta Kali bari)।
রীতি মেনে নিজের বাড়িতে কালীপুজো করলেন মুখ্যমন্ত্রী
কথিত আছে, বর্ধমানের কোটালহাটের কালীমন্দিরে মা কালীর পা চিরে নাকি রক্ত দেখিয়ে দেবী যে জীবন্ত তাঁর প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিয়েছিলেন সাধক কমলাকান্ত। মহারাজ তেজশচন্দ্র বাহাদুর ছেলে প্রতাপচন্দ্র বাহাদুরের চরিত্র সংশোধনের জন্য গুরু কমলাকান্তকে নাকি অনুরোধ করেছিলেন তিনি।
শুধুমাত্র একজন সিদ্ধসাধক হিসেবেই নয়, গায়ক এবং গীতিকার হিসেবে পদাবলি সাহিত্যেও কমলাকান্তের অবদান অসামান্য। তাঁর লেখা গান এবং পদগুলি আজও বাংলা সাহিত্যের অমূ্ল্য সম্পদ।
সাধনার পাশাপাশি গভীর নির্জন অরণ্যে বসে অনেকসময়েই তিনি গাইতেন---
কাজ কী আমার তীর্থে গিয়ে, ঘুরব কেন গয়া-কাশী,
আমার হৃদপদ্ম আলো করে বসে আছে এলোকেশী।।
পদদলে ভক্তিভ্রমর নাম জপিছে অবিরাম, ভোলানাথ বাবার নাম,
আমর মায়ের নামটি দয়াময়ী, ভোলানাথ বাবার নাম।।
ভক্তি, সাধনা, গানকে কমলাকান্ত মিশিয়েছিলেন তাঁর সাধনপথে। ‘সাধকরঞ্জন' পুস্তকে তুলে ধরেছেন সেসব কাহিনি। সহজ সরল ভাষায় লিখেছেন তন্ত্রের গুহ্য কথা---
ইষ্টদেব, মহাসাধককে একসময় নাকি কাশী নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন মহারাজ তেজশচন্দ্র বাহাদুর। যদিও তাতে রাজি হননি তিনি। বলেছিলেন, ‘আমি কমলাকান্ত কালীর ব্যাটা, বিমাতার স্মরণ নিতে চাই না।'
গ্রামের প্রাচীন ইতিহাস সাক্ষ্মী, গঙ্গা নাকি নিজে এসেছিলেন এই গুরুগম্বীর ধ্যানমগ্ন মাহাসাধককে বক্ষে ধারণ করতে। মন্দিরের পাশের সেই ইদারাই গঙ্গাস্বরূপিনী। সেই জলেই মায়ের নিত্য ভোগ রান্না হয়। এই ইদারাই নাকি সেই গঙ্গা।
সাত দশক ধরে মানবতার আন্তরিক বার্তাটি দিয়ে আসছে বড়িশা শান্তি সংঘের পুজো
সাধক নেই। কিন্তু তাঁর সাধনপীঠে আজও প্রতি অমাবস্য়া এবং কালীপুজোয় ভক্তিভরে, নিষ্ঠার সঙ্গে পূজিত হন কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের প্রতিষ্ঠিত দেবী কালীকা। মহাকালের ইশারায় কালের চাকা ঘুরলেও কমলাকান্তের সাধনা, মায়ের প্রতি তাঁর অচলা ভক্তি, তাঁর শ্যামাসঙ্গীত, বাংলা শাক্ত পদাবলীর ইতিহাসে এবং যুগপুরুষ হিসেবে অমরত্ব দিয়েছে তাঁকে।
Click for more
trending news