48 বছর বয়সে প্রথম তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হন করুণানিধি
হাইলাইটস
- পাঁচ বারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ডিএমকের প্রাণপুরুষ করুণানিধি
- 48 বছর বয়সে প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন করুণানিধি
- তামিলনাড়ুর সর্বশেষ নেতা করুণানিধি, যার এমন ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখা দিয়েছে
নিউ দিল্লি: “আমার আশা, আমি সক্রিয় রাজনীতি থেকে কখনোই অবসর নেব না” বলেছিলেন এম করুণানিধি।
কিছু কিছু ছুটি আসলে ঠিক অবসর নয়। যেমন জীবন থেকে ছুটি নিয়েও সারাজীবন রাজনীতির আঙিনায় বেঁচে থাকবেন নেতা করুণানিধি। সবার প্রিয় কালাইগনার। মঙ্গলবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেও কেন্দ্র ও রাজ্যের রাজনীতিতে চিরকালই প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন ডিএমকের এই নেতা।
সম্ভবত তামিলনাড়ুর ইতিহাসে মুথুভেল করুণানিধিই ছিলেন সর্বশেষ জীবিত রাজনীতিবিদ যার জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়েছিল। বিগত কয়েক দশক ধরে, এই রাজ্যের রাজনীতি দুই বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রতিদ্বন্দ্বীতার সাক্ষী ছিল। একজন জয়ললিতা এবং অন্যজন করুণানিধি।
2016 সালে 68 বছর বয়সে মারা যান জয়ললিতা। পাঁচ বারের মুখ্যমন্ত্রী নবতিপর করুণানিধি দীর্ঘ দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। সম্প্রতি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়িতে আসেন তিনি। বিখ্যাত এই দুই নেতারই ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মা ভারতের রাজনীতিতে উজ্জ্বল করে রাখবে এঁদের।
করুণানিধি বা "কালাইনার" – ছিলেন বিখ্যাত স্ক্রিপ্ট লেখকও। বলাবাহুল্য, তাঁর এই লেখনী ক্ষমতা ছয় দশকের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনেও সাহায্য করেছিল তাঁকে।
থাঞ্জাভুর জেলার (অধুনা নাগাপাত্তিনাম) থিরুক্কুভালাই নামের একটি ছোট্ট গ্রামে 1924 সালের 3 জুন জন্ম হয় করুণানিধির। ছাত্রাবস্থাতেই সংস্কারবাদী নেতা পেরিয়র ইভিআরের নেতৃত্বে দ্রাবিড় আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। 1953 সালে বিখ্যাত "কাল্লাকুডি আন্দোলন"-এর নেতৃত্ব দিয়ে রেললাইনের উপর শুয়ে প্রতিবাদ করে তরুণ করুণানিধি প্রথমবারের মতো নজর কাড়েন সবার। এই সময়েই দ্রাবিড় মতাদর্শের নেতা সিএন আন্নাদুরাইয়ের নিবিড় অনুগামী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। 1949 সালে যখন আন্নাদুরাই ডিএমকে প্রতিষ্ঠা করেন, তখন করুণানিধি দলটিতে যোগ দেন। দ্রাবিড় আন্দোলনের ফলেই জন্ম হয় ডিএমকের। ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই নক্ষত্র হয়ে ওঠেন কালাইনার।
1952 সালের "পরাশকথি" চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট লেখেন তিনি। রূপোলি পর্দাকে ব্যবহার করে কীভাবে জনসাধারণের কাছে পৌঁছানো যায় তাঁর আদর্শ উদাহরণ হয়ে রয়েছে এই তামিল সিনেমাটি।
1967 সালে কংগ্রেসের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় ডিএমকে। এবং বাকিটা স্বপ্নের উড়ান। আর কখনওই ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁদের। 1969 সালে ক্যান্সারে আন্নাদুরাইয়ের মৃত্যু হলে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হন করুণানিধি।
2007 সালে এআইডিএমকের সেতুসমুদ্রম প্রজেক্টে 'রামসেতু' নিয়ে ওঠা এক প্রসঙ্গে করুণানিধি বলেন, "কে রাম? কোন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাস করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন তিনি? কোথায় প্রমাণ আছে যে তিনি সেতু তৈরি করেছিলেন?" ঠিক এগারো বছর পর আবার 'রাম'কে কেন্দ্র করেই উত্তাল হয়েছে রাজনীতি। উত্তাল সময়ে দাঁড়িয়ে এমন প্রশ্ন আর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার মানুষকে আজ হারাল ভারতবর্ষ।
করুণানিধির গোটা পরিবারই রাজনীতির সাথে জড়িত। যদিও ভাঙন দেখা গিয়েছে সেখানেও। দায়িত্ব পাওয়া নিয়ে করুণানিধির দুই পুত্র এম কে স্ট্যালিন এবং এম কে আঝাগিরির মধ্যেও সমস্যার শুরু হয়। তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসাবে তাঁর ছোট ছেলে স্টালিনের মনোনয়ন, আঝাগিরিকে বিদ্রোহের মুখে ঠেলে দেয়। বাবা ও ভাইয়ের বিরুদ্ধে অনেক বার কথা বলার পর আঝাগিরিকে 2014 সালে বহিষ্কার করা হয় দল থেকে।
ডিএমকে নেতা এ রাজা এবং করুণানিধির কন্যা কানিমোঝি এবং ভাইপো দয়ানিধি মারান ও কালানিথি মারানের দেশের এযাবৎ কালের সব অন্যতম বড় কেলেঙ্কারি 2-জি স্পেকট্রাম মামলায় জড়িয়ে পড়া ছিল ডিএমকের কাছে সব থেকে বড় ধাক্কা। এমনকি কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারও এই ধাক্কা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি কখনওই।
করুণানিধি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনই প্রথম সামনে আসে এই টেলিকম কেলেঙ্কারিটি। 2011 সালেই নির্বাচনে হেরে যায় ডিএমকে। করুণানিধি সেই সময় বলেছিলেন, "তামিলনাড়ুর মানুষ আমাকে বিশ্রাম দিয়েছেন।" নির্বাচনে দল হারলেও 1957 সাল থেকে কখনওই ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনে হারের মুখ দেখেননি করুণানিধি।
যখন প্রথমবারের মতো মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন করুণানিধি তখন তাঁর বয়স ছিল 48। ওই সময় তিনি জনপ্রিয় অভিনেতা, এম.জি. রামচন্দ্রন বা এম জি আরের সঙ্গে রাজনৈতিক বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। এমজিআর আন্নাদুরাইয়ের মৃত্যুর পর রাজ্যের শীর্ষ পদে করুণানিধিকে উন্নীত করতে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু মতবিরোধের জেরে 1972 সালে করুণানিধি এমজিআরকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। এই একটি মাত্র ভুলেই ঐতিহাসিক পালাবদলের সাক্ষী থাকে তামিলনাড়ু।
তামিলনাড়ু রাজনীতিতে ডিএমকে'র চির প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এমজিআরের গড়া এআইএডিএমকে।
এআইএডিএমকে বা সর্বভারতীয় আন্না দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাঝাঘম 1977 সালে ক্ষমতায় আসে, সেই সময় এমজিআর জানান যে তাঁর জীবিত থাকাকালীন ডিএমকে আর কখনওই ক্ষমতায় ফিরে আসবেন না। এবং বাস্তবেও তাই হয়।
এমজিআর-এর মৃত্যুর পর 1989 সালে করুণানিধি ক্ষমতায় ফিরে আসেন। যখন তামিল টাইগাররা 1991 সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে হত্যা করে, তখন এই হত্যাকারীদের সঙ্গে করুণানিধির ঘনিষ্ঠতার কথা বারেবারেই সামনে উঠে এসেছিল। রাজনৈতিক মহলের মতে, সেই কারণেই 1991 সালেই নির্বাচনে পরাজিত হন করুণানিধি। অভিনেত্রী রাজনীতিবিদ জয়ললিতা ক্ষমতায় এসেছিলেন সেই সময়।
1996 সালে জয়ললিতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ফের ডিএমকে ফিরে আসে ক্ষমতায়। তারপর থেকেই প্রতি পাঁচবছর মেয়াদ পর পর দুই পক্ষই শাসন চালিয়েছে এই রাজ্যে। একমাত্র 2006 সালে জয়ললিতা টানা দু’বার জিতে ঐতিহাসিক নিদর্শন রাখেন রাজনীতিতে।
গত কয়েক বছর ধরেই জনসমক্ষে দেখা যেত না ডিএমকে প্রধানকে। হুইলচেয়ারেই কেটেছে তাঁর দিন। মঙ্গলবার শেষ হয় তাঁর জীবনের সফর। যদিও ভারতীয় রাজনীতিতে মৃত্যুর পরেও অম্লান থেকে যাবে তাঁর অনিবার্য প্রজ্ঞার লড়াকু আলোটুকু।