This Article is From Jan 08, 2019

BLOG: মাঝেরহাট ব্রিজ, তুমি আমাদের বড় আপন ছিলে

আমাদের বেহালাবাসীর বলার মতো একটা সৌরভ আর একটা চণ্ডীমেলা ছাড়া আর প্রায় কিছুই ছিল না কখনও। আমরা আদতে ‘কলকাতা’র মানুষ কি না, তা নিয়েও নিজেদের মনেই ছিল ঘোরতর সংশয়

Advertisement
Featured Posts

ওদিকে মোমিনপুর, একবালপুর। এদিকে বেহালা, ঠাকুরপুকুর। মাঝখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে খাল। সেই খালের পাশ দিয়ে রেললাইন। খাল টপকে ট্রেন এসে দাঁড়ায় মাঝেরহাট স্টেশনে। এক কামরা ভর্তি লোককে উপুড় করে দেয় তারপর। প্ল্যাটফর্ম থেকে নতুন লোককে তুলে ট্রেনটি হুইসল দিয়ে ব্রেসব্রিজের দিকে চলে যায়। মাথায় ঝুড়ি বছর পঞ্চাশের আক্রানিবাসী ইকবাল হোসেন, কমদামী ছাপার শাড়ি পরা ও শাঁখাপলা যুক্ত বাঁহাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে আরতি মণ্ডল- ব্যাগের ভিতর থেকে কয়েকটা পুঁইডাঁটা মাথা উঁচু করে রয়েছে, তিন বছর আগে কেনা চামড়ার জুতো পরে নেমে আসা মলিন জামার কলেজ-কিশোর…এই ভিড়টির অংশ এরা সকলেই। খালের ওপরে রয়েছে ব্রিজ। নাম-না-জানা একটি হাওয়া আকাশ থেকে সোজা নেমে এসে সেই পিচঢাকা ব্রিজের রাস্তার একটা বড় অংশ জুড়ে পড়ে থাকা ধুলোকে বল্লমগাঁথা করে নিয়ে স্যাঁত করে তুলে দিয়ে সাংঘাতিকভাবে উপড়ে ফেলে দিল। ব্রিজটা হুহু করে পেরোতে থাকা চারচাকা গাড়ির জানলার দিকে আঙুল তুলে এক মা তার পাঁচ বছরের ছেলেকে দেখাল, কীভাবে একটা ট্রেন হুইসল দিয়ে মেঘের ভিতরেই মিশে যায় শেষমেশ।আর, এই গোটা মুহূর্তটার সাক্ষী হয়ে রইল ওই খালের ওপরে থাকা মাঝেরহাট ব্রিজ। 

কারখানা থেকে নাইট ডিউটি সেরে ভোর ভোর কারখানার বাথরুম থেকেই স্নান করে এক কাপ চা খেয়ে সকাল সকাল সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল বাসব দত্ত। কথায় একটু মেয়েলি টান আছে বলে বন্ধুরা খেপায় ‘বাসবদত্তা' বলে। ব্রিজে উঠেই সে দাঁড়িয়ে গেল। একটা মালগাড়ি যাওয়া দেখবে। ব্রিজের তলা দিয়ে মালগাড়ি যাওয়ার সময় ব্রিজটা কেঁপে ওঠে মৃদু। বাসব দত্তের তখন মনে হয়, এই ব্রিজটা যদি ভেঙে পড়ে যায় তার পায়ের তলা থেকে, তাহলে কী হবে? তার একটি ছোটছেলে আছে। প্রাইমারি ইস্কুলে পড়ে। মিড-ডে মিলে খিচুড়ি খায়। একদিন ডিম খেয়ে পেটখারাপ করে ফেলায় তিনদিন ইস্কুলে যেতে পারেনি। তারপর থেকে ওকে আর ইস্কুল ডিম দেয় না। ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলে বলে, আমাকে ঘোড়ার ডিম দেয়। ব্রিজ ভেঙে পড়লে নিজের ছেলেটিকে আর কখনও দেখা হবে না ওর। কয়েক বছর আগেও রাতে এক কাতে বিছানায় শুয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে বিছানার অন্যদিকে চলে যেত ভোরবেলা। বউ এখন আট বছরের পুরনো। তার আগে পাঁচ বছরের প্রেম। তেরো বছর আগে এই সাইকেলের সামনে বসিয়েই বউকে নিয়ে ব্রিজ পেরিয়ে যেত। মাঝেমাঝে কোনও বনধের দিনে সাইকেলটা নিয়ে দাঁড়াত ব্রিজের মাঝখানে। মালগাড়িটি ব্রিজটাকে কাঁপিয়ে দিয়ে তলা দিয়ে চলে যায় একসময়। বাসব দত্ত সাইকেলে উঠে পড়ে। ও ভাবে, আজও মরা হল না।

ওই সকালেই বাসব দত্তের থেকে আরেকটু দূরে ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়েছিল একজন কিশোর। তার শখ নানা রঙের বোতাম জমানো। বহু পুরনো বোতাম, নতুন বোতাম…এক-একটি বোতামের সঙ্গে এক-একটি স্মৃতি জুড়ে থাকে। স্মৃতির ঘেমো গন্ধ লেগে থাকে বোতামের গায়ে। বোতামের ভিতরে থাকা ছোট ছোট ফুটোর মধ্য দিয়ে সে দেখার চেষ্টা করে বোতামের ওপারে থাকা স্মৃতিটিকে। কখনও কখনও পেয়ে যায়। কখনও পায় না। একবার একটি বোতামের ভিতর দিয়ে এভাবে নজর করেই সে দেখতে পেয়েছিল মৈথুনরত অবস্থায় এক ঘুপচি ঘরের তেলচিটে বিছানায় অচেনা নারী ছিঁড়ে নিল চেনা পুরুষের বোতাম। পুরুষটি তার বাবা। আরেকবার একটি প্লাস্টিকের বোতামের ভিতরে তাকিয়ে দেখতে পেয়েছিল, একটি বাচ্চা ছেলের জামা ধরে টানাটানি করে তা খুলে ফেলে দিল একদল লোক। তারপর ছেলেটিকে একটি বিশেষ ধর্মের নামে জয়ধ্বনি দিতে বলে জ্বালিয়ে দিল তারা। বোতামটি পড়ে রইল নর্দমার একপাশে। এই ঘটনাটা পুরোটা দেখার পর, বোতামটিকে ওই কিশোরের চাঁদের মতো মনে হয়েছিল।  আরেকটি শখও আছে তার। বোতাম দিয়ে এক-একটি অক্ষর তৈরি করা। সেই অক্ষর থেকে শব্দ এবং বাক্য। তারপর তা কার্ডের গায়ে আঠা দিয়ে আটকে প্রিয় মানুষের হাতে তুলে দেওয়া। ব্রিজের হাওয়া খেতে খেতে সে ভাবছিল, ঠিক কী লেখা যায় কার্ডের গায়ে? কেমন আছিস? নাকি, কোচিং থেকে বেরোনোর পর একবার আমার সঙ্গে রাধুদার দোকানে এগ রোল খেতে যাবি? অনেকদিন ধরে পয়সা জমাচ্ছি…বাসব দত্ত এবং ওই কিশোরের মতোই এই ব্রিজটির ওপরে বহু দুপুরবেলায় দাঁড়িয়ে থাকতাম আমি ও আমার বন্ধুরা। তখনও ট্রাম চলত বেহালায়। ব্রিজের ওপর দিয়ে ‘ঘটি গরম' ‘ঘটি গরম' শব্দ করতে করতে চলে যেত ট্রাম। ব্রিজ থেকে নামার পরই তার শব্দটা পিয়ানোর মতো হয়ে যায়। 

Advertisement

আমরা যারা নব্বই দশকে বেহালা অঞ্চলে বেড়ে উঠেছি, পড়েছি এই অঞ্চলের ইস্কুল ও কোচিং-এ, তাদের প্রায় প্রত্যেকের কাছেই মাঝেরহাট ছিল প্রথম দেখা ব্রিজ। আমাদের সকলেরই ঝুলনে যে ব্রিজটি থেকেই যেত প্রতি বছর, তা মাঝেরহাট। একটি ব্রিজ মানে একটি আশা। এছাড়া, খুব ছোটবেলায়, যখন বাড়িতে ছাদ ছিল না, তখন মাঝেরহাট ব্রিজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েই প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম, উপর থেকে দেখলে নিচের মানুষদের কত ক্ষুদ্র দেখায়। খানিকটা তুচ্ছও দেখায় বটে। কলেজে পড়ার সময় আলুকাবলি খেয়ে মাঝেরহাট ব্রিজের ওপর দিয়ে শালপাতা উড়িয়ে দিতাম তৎকালীন প্রেমিকার সঙ্গে। হাওয়ায় হাওয়ায় শালপাতাটা ভাসতে ভাসতে মহাকাব্যের পাতায় মিশে যেত। একটি আলুকাবলির শালপাতা যে কখনও কখনও পাখি হয়ে যেতে পারে, তা প্রথম জানতে পেরেছিলাম এই ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়েই। ইলেভেনে ফিজিক্সে আর কেমিস্ট্রিতে পাশ করতে না পেরে এক বন্ধু সুইসাইড করবে বলে ঠিক করে। কোথায় থেকে? না, মাঝেরহাট ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দেবে! কেন? এই প্রশ্নের একটিই উত্তর, সে ঝাঁপ দিয়ে মরতে চায়। কিন্তু আমাদের এলাকায় তো ঝাঁপ দেওয়ার মতো তখন তত বড়বাড়ি বা ওই ধরনের কিছুই ছিল না। শহরটা যদি কুমীর হয়, তাহলে বেহালা বা ঠাকুরপুকুর অঞ্লগুলো তার কাঁটাওয়ালা লেজের একদম শেষদিকটা। সেখানে প্রায় কিছুই নেই। কেবল জ্যাম ছাড়া। তা, সেই বন্ধু মাঝেরহাট থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরতে চায় শুনে আরেক বন্ধু বিকেলবেলার মাঠে বসে জিজ্ঞাসা করেছিল, ব্রিজ থেকে লাইনে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে কোনও চিল যদি ছোঁ মেরে তোর বডিটা নিয়ে উড়ে যায়, তখন? লেখাই সঙ্গত, ছেলেটি আর আত্মহত্যা করেনি। এখন পূর্ব ইউরোপের একটি দেশে থাকে। আবার, আরেকরকম বন্ধুত্বের সাক্ষীও থেকে ছিল এই মাঝেরহাট ব্রিজই। চোদ্দ বছর আগের এক ভারত বনধের দুপুরবেলা তৎকালীন এক বন্ধু মোমিনপুর পর্যন্ত সাইকেলের পিছনের সিটে বসিয়ে নিয়ে গেল। একদম ফাঁকা রাস্তা। মাঝেমাঝে কয়েকজন সচিন-সৌরভ ক্রিকেট খেলছে। তা, সেই বন্ধু ফেরার সময় মাঝেরহাটে ওঠার পরই সাইকেল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলল, আর পারছি না। তুই হেঁটে চলে যা। তারপর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে সাইকেল নিয়ে ব্রিজ দিয়ে হুড়হুড় করে নামতে নামতে চলে গেল। বিশ্বাসভঙ্গের পরমুহূর্ত থেকেই মানুষ কীভাবে নিচে নেমে যেতে আরম্ভ করে, তাও প্রথম জানতে পেরেছিলাম এই ব্রিজে দাঁড়িয়ে।

আমাদের বেহালাবাসীর বলার মতো একটা সৌরভ আর একটা চণ্ডীমেলা ছাড়া আর প্রায় কিছুই ছিল না কখনও। আমরা আদতে ‘কলকাতা'র মানুষ কি না, তা নিয়েও নিজেদের মনেই ছিল ঘোরতর সংশয়। পিনকোডে লিখতাম ‘কলকাতা অমুক', অথচ, বাবা কাজে বেরোনোর সময় ‘কোথায় যাচ্ছ' প্রশ্নের উত্তরে বলে, ‘কলকাতায় যাচ্ছি'। মেলাতেই পারতাম না। কলকাতায় থাকলে ‘কলকাতা যাচ্ছি' বলে কী করে?! আমি তো বাড়ি থাকলে ‘বাড়ি যাচ্ছি' বলি না! সোজা রাস্তায় মাঝেরহাট পেরোলেই মোমিনপুর। বাড়ির স্টপেজ থেকে পাক্কা আধঘন্টা। মোমিনপুরে এলেই বুঝতে পারতাম একটা ‘কলকাতা, কলকাতা' গন্ধের মধ্যেই প্রবেশ করে গেলাম।

Advertisement


এর পর কেটে গিয়েছে বহু বছর। বেহালাটা অনেক বদলে গিয়েছে। ট্রাম উঠেছে। এসেছে থাম। মেট্রোর লাইনের জন্য। যদিও, তা কবে শেষ হবে কেউ জানে না। বেহালা নিয়ে প্রায় একটি মিথেরই জন্ম হয়ে গিয়েছে যে, এখানে সবকিছুই শুরু হয়, কিন্তু কিছুই শেষ হয় না। আজ তৈরি করা নতুন রাস্তা কাল খুঁড়ে দেওয়া হয় পাইপ বসবে বলে। অল্প বৃষ্টিতে কোমর পর্যন্ত জল জমে যায়। অন্য জায়গা থেকে বেহালা আসব বললে একশো টাকা বেশি ভাড়া দিলেও ট্যাক্সিওয়ালারা তাচ্ছিল্যের হাত নেড়ে নাকচ করে দেয়। এমন একটি ক্রমাগত হেরে যাওয়া, পিষে যাওয়া, ছিবড়ে হয়ে যাওয়া স্থানের বাসিন্দা আমাদের আক্ষরিক অর্থেই একটি উত্তরণের জায়গা ছিল এই মাঝেরহাট ব্রিজ। আমাদের প্রথম উপর থেকে দেখার আনোখা স্বাদ। এক মাস হয়ে গেল যে ব্রিজটি আর নেই। ভেঙে পড়ে গিয়েছে।

তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বহু মিম তৈরি হয়েছে, কয়েক হাজার জোকও মাতিয়েছে বাজার। কেবল আমরা জানি, ওই কারখানার শ্রমিক ওই বোতাম জমানো কিশোর ও আমাদের মতো এই অঞ্চলেই বেড়ে ওঠা ও স্বপ্ন দেখতে থাকা মানুষরাই জানি যে, আমরা আসলে হেরোই ছিলাম চিরকাল। মাঝেরহাট ছিল আমাদের সাধের ‘লন্ডন আই'। যে ব্রিজ ভেঙে গিয়ে বেহালা, ঠাকুরপুকুর, জোকা, পৈলান, আমতলা সহ বহু বহু জায়গার মানুষগুলোকে আরও একটু পরাজিত করে দিয়ে গেল।

Advertisement


এই হেরো মানুষদের নিয়েই তৈরি এক নিঃসঙ্গ দ্বীপের বাসিন্দা এখন আমরা। যেখানে আর কেউ কখনও রঙিন চশমা বিক্রি করতে আসবে না… 

 

Advertisement

 

DISCLAIMER (প্রত্যাখ্যান) : এই ব্লগে লেখক নিজের বিচারধারা ব্যক্ত করেছেন। এই নিবন্ধের মধ্যে যে বক্তব্য পেশ করা আছে তার জন্য NDTV কোনো ভাবেই দায়ী নয়। নিবন্ধে যে তথ্য বা মনোভাব ব্যক্ত করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভাবেই লেখকের নিজেস্ব চিন্তার অভিব্যক্তি।  তার জন্য NDTV কোনো ভাবেই দায়ী নয়।  এর জন্য NDTV কোনো ভাবেই জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়.

Advertisement