মান্টোর ভূমিকায় নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী
অভিনয় :- নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী,রাশিকা দুগ্গল, তাহির রাজ ভাসিন
পরিচালক :- নন্দিতা দাস
রেটিং :- 4/5
(2018 এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম প্রদর্শনের ওপর ভিত্তি করে মান্টো-এর পর্যালোচনা করা হলো।)
সিনেমাটি শুরু হচ্ছে গোবিন্দ নামক এক জন পান বিক্রেতাকে দেখানোর মধ্যে দিয়ে যার সাথে প্রধান ছড়িতের মনন খুব সুন্দর জড়িয়ে পড়ে গল্পটির গুরুত্ব অনেকখানি বাড়িয়ে তুলেছে। দেশ ভাগের হিংস্রতার মধ্যে লেখক যখন লাহোর চলে যান তখন তিনি তার 1940 এর মুম্বাই সিনেমার অভিনেতা বন্ধু শ্যাম চাড্ডাকে জানান যে ওই পানওয়ালার থেকে ধার করা 1 টাকা তিনি কোনোদিনই তাকে ফেরত দেবেন না কারণ ওই একটি টাকা তাকে সর্বদা মনে করবে সেই মুম্বাই এর কথা যেখানে তার বাবা, মা এবং প্রথম সন্তান কে তিনি কবর দিয়েছিলেন। এই ছোট্ট মুহূর্তটি লেখকের কষ্ট অনুভব করানোর জন্য যথেষ্ট এবং দর্শকের চোখে জল এনে দিতে বাধ্য।
একথা বলা যায় না যে লেখক-পরিচালক এই প্রকারে দর্শক এর আবেগ আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। এর পরিবর্তে তিনি আমাদের কোথাও হয়তো মনে করিয়ে দিতে চান ভারতের ভয়ানক দেশভাগ এর ইতিহাস কে। কিন্তু সত্যি কি আমরা তা অনুভব করতে পারি? এই অবস্থার কথাই উর্দু ভাষার ছোট গল্প লেখক সাদাত হাসান মান্টো তার উত্তেজক, সংবেদনশীল এবং উন্নত লেখনীর মাধ্যমে তার অতি সংক্ষিপ্ত লেখক জীবনে বোঝাতে চেয়েছিলেন।
মান্টো-জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা গুলির মধ্যে থেকে পরিচালক খুব ছোটো করে কয়েকটি ঘটনাকে তার সিনেমায় তুলে ধরেছেন নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী,রাশিকা দুগ্গল, তাহির রাজ ভাসিনের অসাধারণ অভিনয় দক্ষতার মাধ্যমে।
এছাড়াও তৎকালীন মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র অভিনেতা অশোক কুমার,বাদ্যযন্ত্র তারকা জাদ্দান বাঈ,সংগীত শিল্পী নওশাদ,লেখক কৃষাণ চান্দার ছাড়াও অন্যান্য গুরুত্ত্বপূর্ণ অভিনেতা অভিনেত্রী-এর ভূমিকায় দিব্যা দত্ত, তিলোত্তমা সোম, রণভীর সোরে, শশাঙ্ক অরোরা, বিজয় ভার্মা, চন্দন রায় সান্যাল প্রমুখের অভিনয় অসাধারণ। পাকিস্তানী এক পন্ডিত ব্যক্তির ভূমিকায় জাভেদ আখতার যখন মান্টোর পাশে দাঁড়ান কোর্টে যেখানে তাকে নিষিদ্ধ সাহিত্য লেখার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, সেই সময়ে তার অভিনয় এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে।
মান্টো সারাজীবন সত্যের পিছনে ছুটেছেন, কোনো বাধাই তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি এবং তিনি যে তৎকালীন পরিস্থিতির প্রতি কতটা বিরক্ত ছিলেন তা তার কথা "ধর্ম হৃদয় থেকে মাথা পর্যন্ত মস্তিষ্কে বিস্তারিত হয়" শুনলেই বোঝা যায়। মুম্বাই এর সিনেমার প্রোডিউসার (এই ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ঋষি কাপুর তার গতানুগতিক অসাধারণত্বের সাথে) এবং লাহোরের প্রকাশকদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্যই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক সত্যের পথে মান্টোর এই অদম্য ছুটে চলা কোনো বাধাই মনে নেই।
71 তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত মান্টো আমাদের দেশের তৎকালীন 'গরম হাওয়া' এর পরিচয় বহন করে নিয়ে আসে। দুঃখ ও রাগ এর সঙ্গে লেখক যে অনুভূতি প্রকাশ করেন এবং যে আতঙ্কের প্রতিফলন ঘটান তা আজকের প্রগতিশালী, সামাজিকভাবে স্থিতিশীল ও সাংস্কৃতিক চিন্তাশীল ভারতীয়দের মনের মধ্যে আজও উদ্বেলিত হয়ে চলেছে।
নন্দিতা নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ববাসীর কাছে তার এই সিনেমাটি তুলে ধরেছেন যেখানে চিন্তা আছে,সমবেদনা আছে,আছে হাস্যরসের উপাদানের পাশাপাশি আশাব্যাঞ্জক ধারণাও।
'মান্টো'একটি দেখার মতো, তাৎক্ষণিক চিন্তা উদ্দীপক সিনেম্যাটিক কাজ যাতে মান্টো অর্থাৎ নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী তার অভিনয়ের মাধ্যমে সমাজ এর তৎকালীন পরিস্থিতিকে অত্যন্ত সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন। প্রতিটি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র মুহূর্তের অভিনয় অত্যন্ত সুন্দরভাবে নওয়াজ তার চরিত্রের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন।
রাশিকা দুগ্গল লেখক মান্টোর স্ত্রী সাফিয়া মান্টোর ভূমিকায় অসাধারণভাবে অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠেছেন। লেখকের অস্থির পরিস্থিতির সময় যেভাবে একজন স্ত্রী পাশে এসে দাঁড়ান তা অত্যন্ত সুন্দর ভাবে তিনি তার চরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রথমবার বড়ো পর্দায় দীর্ঘ সময়ের অভিনয়ে।
তাহির রাজ্ ভাসিন অভিনীত শ্যাম চরিত্রটি মান্টোর আবেগের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। সিনেমার প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষত মান্টোর মুম্বাই ছেড়ে লাহোর চলে যাওয়ার সময়ে পুরাতন স্মৃতিচারণের দৃশ্যে এই তরুণ অভিনেতার অভিনয় লক্ষ্যণীয়।
প্রত্যেক টেকনিশিয়ান যেমন সিনেমাটোগ্রাফার কার্তিক বিজয়, সাউন্ড ডিজাইনার রসূল পুকুট্টি, এডিটর এ.শ্রীকর প্রসাদ এবং প্রোডাকশন ডিজাইনার রিতা ঘোষ প্রত্যেকেই আলাদা মাত্রা যোগ করেছেন ছবিটিতে। মান্টো মাত্র 42 বছর বয়সে স্বাধীনতার 7 বছর পর মারা যান, উপমহাদেশের তাৎক্ষণিক দৈন দশা থেকে তাকে টেনে বের করে আনার আপ্রাণ প্রচেষ্টার পর।