এই গ্রামে সকলেই একে অন্যকে ছোট্ট একটি সুর দিয়ে ডাকে (ছবি এএফপি)
অনেকদিন আগেই সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন, “ভাষা এমন কথা বলে বোঝেরে সকলে।” কথোপকথন নাই বা হোক, যোগাযোগের জন্য হরেক ভাষাই তো আছে, কারও ভাষা কথ্য, কারো ভাষা শরীরী, কারও আবার সঙ্গীতই ভাষা। কিন্তু সুর দিয়ে মানুষকে ডাকা যায়? শুধু সুরেই কথা বলা যায় দিবারাত্র? এর উত্তর পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে খাসি গাঁয়ে, মেঘালয়ের কোলে সবুজ রঙের এই শান্ত গ্রামে মানুষের কোনও কথ্য ডাকনাম নেই, সুরেই একে অন্যকে ডাকেন তাঁরা। ঢুকলেই কৌতুহলী শিস, খানিক কিচিরমিচির ভেসে আসবে কোংথং গ্রাম থেকে। তবে পাখি নয়, এখানে এভাবে মানুষ ডাকে একে অন্যকে। এ এই গ্রামের এক অনন্য ঐতিহ্য।
মেঘালয়ের কোংথং গ্রামে প্রতি সদ্যোজাতের জন্য আলাদা আলাদা সঙ্গীত তৈরি হয়। প্রতিটি বিশেষ সঙ্গীতই আজীবনের পরিচয় হয়ে থেকে যায় ওই মানুষটির।
গ্রামের প্রত্যেকেই খাসি সম্প্রদায়ের মানুষ। স্বতন্ত্র সুরটি সারাজীবনের জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে সম্বোধন করতে ব্যবহৃত হয়। ঐতিহ্যগত "বাস্তব" নামও আছে মানুষের, তবে তা খুব কমই ব্যবহৃত হয়।
টিনের ছাদ দেওয়া কাঠের কুঁড়ে ঘর ছড়িয়ে রয়েছে পাহাড়ি উপত্যকায়। সবুজ গন্ধের তীব্রতা ছুঁয়ে আছে প্রতিটি বাড়ির আনাচকানাচ। আসলে এক সুরময় পৃথিবী, এক সুরেলা গ্রাম কোলে নিয়ে বসে আছে আস্ত এক পাহাড়। উপত্যকা জুড়ে বাঙময় সিম্ফোনি।
একদিকে মা তার ছেলেকে ডাকছে, কোথাও আবার অন্য বাচ্চারা ঘুরে ঘুরে তাঁদের বন্ধুকে ডাকছে খেলতে যেতে- সমস্তটাই সুরে, প্রত্যেকের জন্য বাঁধা আছে নির্দিষ্ট সুর।
"এই সঙ্গীত আমার হৃদয়ের গভীর থেকে আসে,"-বলেন তিন সন্তানের মা। হাঁটুর উপর নিজের আড়াই বছরের ছোট্ট মেয়েকে বসিয়ে ওই মা বলেন, "এটা আমার শিশুর জন্য আমার মনের আনন্দ এবং ভালবাসার প্রকাশ।"
"কিন্তু যদি আমার ছেলের কিছু ভুল করে, যদি আমি ওর উপর রেগে থাকি সেই মুহূর্তে আমি ওঁকে ওর আক্ষরিক নাম ধরে ডাকি।" বলেন ওই সম্প্রদায়ের নেতা রথেল খোংসিত।
প্রকৃতির সাথে একাত্মতা -
বিশ্বের অন্যসমস্ত এলাকা থেকে বিচ্ছিন্নপ্রায় এক বসতি এই গ্রাম। সবচেয়ে কাছের গ্রামটি থেকেও ট্রেক করে যেতে সময় লাগে সাত ঘণ্টা। এই গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে ২000 সালে এবং সড়ক তৈরি হয়েছে ২013 সালে। জঙ্গলে একে অপরকে ডাকার জন্য, গ্রামবাসীরা প্রত্যেককে সঙ্গীতের "নাম" দেন। 30 সেকেন্ডের এক একটা সঙ্গীতই এক একজনের নাম। প্রকৃতির নানা শব্দ থেকেই উঠে আসে তাঁদের শব্দ, তাঁদের নিজস্ব নামসঙ্গীত।
খোংসিত বলেন, "আমরা অনেক দূরবর্তী গ্রামে বসবাস করি, পাহাড়ে ঘন জঙ্গল ঘিরে রয়েছে আমাদের। তাই আমরা প্রকৃতির সাথে নিবিড়, আমরা সৃষ্টিকর্তার তৈরি সকল নিবিড় প্রাণের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি"।
"প্রত্যেক প্রাণির নিজস্ব পরিচয় আছে। পাখিদের, বা অন্য অনেক প্রাণিদের এঁকে অপরকে ডাকার আলাদা আলাদা পদ্ধতি রয়েছে।" এই প্রথাটি "জিংরাওয়াই লওবেই" নামে পরিচিত, যার অর্থ "বংশের প্রথম নারীর গান।" এই প্রথাটি খাসি জনগণের ‘মা’ সম্বন্ধীয় পৌরাণিক ধারণা থেকেই অনুপ্রাণিত। ভারতে সাধারণভাবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পরিলক্ষিত। কিন্তু এই পাহাড়ি মানুষদের সমাজ মাতৃতান্ত্রিক বা ম্যাট্রিলিনাল। সম্পত্তি ও জমি মা এবং মেয়েকে প্রেরণ করা হয়। একজন স্বামী তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে চলে যান, স্ত্রীয়ের নাম গ্রহণ করেন।
"আমরা মা’কে পরিবারের দেবী বলে জানি। আমাদের পূর্বপুরুষদের উত্তরাধিকারের পর একজন মা’ই তাঁর পরিবারকে দেখেন," বলছেন খোংসিত।
আধুনিক বিশ্ব-
দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টিপ্লুত নংব্রির কথায়, এটি আসলে একটি ছদ্মবেশী পিতৃতান্ত্রিকতা। নারীর এখানে "সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা নেই। ঐতিহ্যগতভাবে তাঁরা রাজনীতিতে অংশ নিতে পারেন না। সামাজিক নিয়ম পুরুষ এবং মহিলা মধ্যে খুব পরিষ্কারভাবেই নির্ধারিত হয়। শিশুদের যত্ন নেওয়া নারীর দায়িত্ব। বাকি সমস্ত কাজ শুধুই পুরুষের জন্য।”, জানান অধ্যাপক নংব্রি। "জিংরাওয়াই লওবেই" এর উৎপত্তি জানা যায় না, কিন্তু স্থানীয়রা মনে করেন এটি তাঁদের গ্রামের মতো পুরনো, পাঁচ শতাব্দী ধরে চলে আসছে এই নিয়ম। তবে মোবাইল আর টিভির এই বিশ্বে বিশেষ নিজস্বতা, ঐতিহ্য সকলই অনেক লঘু হয়ে পড়েছে। সে কারণে অনেক শিশুর নাম সঙ্গীতেও ছাপ পড়েছে বলউডি গানের। এখন আর খেলতে যাওয়ার মিঠে সুর বাজে না, বন্ধুরা মোবাইল রিংটোনে সেরে নেয় কথোপকথন।
Click for more
trending news