কলকাতা: ঘটনা ১; পুরুলিয়ার একটি গ্রাম। আগন্তুক এক সমীক্ষক হঠাৎ এসে পড়েছেন ঘরে। অগত্যা দুপুরের খাবারের আতিথেয়তা। খেতে বসে পরিবারের প্রতিটি পাতে নজর গেল ওই সমীক্ষকের। দু'ভাই বোনের মধ্যে বোনের পাতেই মাছের অংশটি সব থেকে ছোট। কলপাড়ে হাত ধুতে গিয়ে সমীক্ষক আর না জিজ্ঞেস করে পারলেন না, “হ্যাঁ রে, আমি আজ হঠাৎ এসে পড়লাম বলে তোর মাছ কম পড়ে গেল বল?” বছর ৭ কি ৮, বেণি দুলিয়ে উত্তর দিল, “কই না তো! আমি তো এমনই খাই, অল্প করে, মেয়েদের তো কম খেতে হয়।”
ঘটনা দুই; অনেকদিন ধরেই ছক কষে চলেছে যুবক। রাজি না হওয়ার পাল্লায় ভারী বোঝা চাপিয়ে রেখেছে তরুণী। জোর করে কি প্রেম হয়? অতএব মালদায় টিউশনি ফিরতি পথে অ্যাসিডের বোতলের টিপ মিস করে না যুবা। সৌন্দর্য নষ্ট মানেই তো মাল ডিফেক্টেড। মেধা না, মনন না কেবল চামড়া আর চুলের সৌন্দর্যই এখানে সারসত্য।
ঘটনা তিন; ইয়ে হ্যায় কলকাত্তা! এখানে সব কিছু ভালো, সব চকমকে ঝকঝকে। এখানে রাতে উবের ওলা। এখানে রাতে ড্রাইভার ফুটপাথ থেকে কিশোরী হতে চলা মাংসপিণ্ডদের তুলে নিয়ে আশ ও দ্বেষ মিটিয়ে সোজা খালের জলে ফেলে দেয়। মরে, গলে আর পচে যায় শিশু কন্যা, কিশোরী, যুবতী এবং প্রতিটি জাতীয় কন্যাশিশু দিবস।
নেতাজি সুভাষের টুপি মোদির হাতে তুলে দিলেন বসু পরিবার। জানুন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া
সাংবিধানিক অধিকার, মৌলিক অধিকার, পড়ার অধিকার, খেলার অধিকার, সুস্বাস্থ্যের অধিকার, সমান মাইনের অধিকার মনে করিয়ে দিতে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস আসে, যায়ও। কেউ বেটি বাঁচাও বেটি পড়াওয়ের বার্ষিকী উদযাপন করেন, কেউ বা কন্যাশ্রীর। কিন্তু আমাদের কন্যাদের কথা এখনও কেবলই খাবি খায়। একখানা সভ্য পৃথিবীতে সরকারকে এখনও মানুষকে জানাতে হয়, মেয়েদের মেরে ফেলো না, মেয়েদের পড়াও। মানুষকে তো তাই মনে করাতে হয় যা হয় সে ভুলে যায়, বা যা তাঁর জানাই নয়। শিশু কন্যাকে নিয়ে কী কী করতে হবে তা রাষ্ট্রযন্ত্রকে মনে করাতে হচ্ছে অর্থাৎ, আমরা দিব্যি সভ্য আছি, সুখে আছি, ভুলে আছি।
২০১৯ সালের এই বিশেষ দিনটির থিম হল, “উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লক্ষে মেয়ের ক্ষমতায়ণ” (Empowering Girls for a Brighter Tomorrow)। এ ক্ষমতা আর অধিকার কে কাকে দেয়? মাঝে মাঝে তো কেড়েই নিতে হয়। অন্তত এ দেশের ইতিহাস তাই বলে। কিন্তু, কোথায় কোথায় মেয়েরা ক্ষমতাহীন সেই জিজ্ঞাসাটাই এই সমাজে তৈরি হয় না অধিকাংশ মেয়ের। সুতরাং মাছের সবচেয়ে কম অংশ পাওয়া মেয়েটিকে তাঁর ক্ষমতা নিয়ে ও সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেওয়া হয় না। এখানে বিয়ে মেয়ের জন্য সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বলেই ত্বকের সৌন্দর্য আর শরীরকে ভীষণ করে অপবিত্র মনে করা এখানে যুগ যুগ ধরেই শেখানো হয় মেয়েদের। অ্যাসিডের ক্ষত নিয়ে কেন মেয়েকে লজ্জা পেতে হবে বা ধর্ষিতা হলে তার সঙ্গে ‘ইজ্জত' চলে কেনই বা যাবে এই নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার বোধটুকু জন্ম থেকেই মিসিং। প্রতিটা কন্যাশিশু দিবস আসলে জানান দেয়, সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারকে কীভাবে শিশুকে মানুষ করতে হবে সেই পাঠ বড়ো দরকার। মেয়েকে নারী হিসেবে বা ছেলেকে পুরুষ হিসাবে বড় না করে তোলার মধ্যেই অনেক সমস্যার সমাধান লুকিয়ে হয়ত।
বের করে দিল হাসপাতাল! রাস্তায় সন্তান প্রসব করলেন মহিলা
জন্মের পরে মেয়েকে খেলনা বাটি, লাস্যময়ী বার্বিপুতুল আর ছেলেকে গাড়ি বন্দুক না দিয়ে বরং দু'জনকেই সমান উপহার দেওয়া হোক। হতেই তো পারে, ছেলেটিও খেলনা বাটি নিয়ে একদিন দুর্দান্ত শেফ হয়ে উঠল, আর মেয়েটিও গাড়ি খেলতে খেলতেই শ্রেষ্ঠ বাইক রেসার হয়ে উঠল। সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমেই ক্ষমতায়ণ হোক, প্রতিটা দিন শিশুদের হোক, কন্যাদেরও, পুত্রদেরও।