ঝরে গেলেন মিস শেফালি (সৌজন্যে ফেসবুক)
কলকাতা: চলে গেলেন কলকাতার প্রথম ‘রাতপরি' Miss Shefali। বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। খবর, দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে কিডনির সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালে। দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছিল তাঁর। শেষের দিকে প্রায়ই নাকি বলতেন, আর বেশি সময় নেই হাতে। এবার তিনি ছুটি নেবেন। হাসপাতাল থেকে সোদপুরে নিজের বাড়িতে ফেরার পরেও বেশ সুস্থই ছিলেন। আচমকাই বৃহস্পতিবার ভোরে ঝরে গেলেন চিরকালের মত। সপ্তাহ দুয়েক আগে তাঁকে নিয়ে বইও বেরিয়েছে।
কলকাতা এবং ছা-পোষা বাঙালি তখনও ক্যাবারে কালচারের সঙ্গে পরিচিত নয়। সমাজ আরও রক্ষণশীল। সেই সময় সাতের দশকে নিতান্ত পেটের দায়ে তিলোত্তমায় বিপ্লবের মতো আছড়ে পড়েছিলেন আরতি দাস। তিনিই হোটেল ফিরপো-র ক্যাবারে ক্যুইন মিস শেফালি। পরে পার্ক স্ট্রিট, গ্র্যান্ড হোটেল বুঁদ হয়েছিল তাঁর নাচের নেশায়। কালের নিয়ম মেনে একটা সময় ভাটার টান আসে তাঁর জনপ্রিয়তাতেও। শেষের দিকে অর্থাভাবে ঠিক মতো চিকিৎসাও হচ্ছিল না তাঁর। সেই সময় তাঁর দেখভাল করেন অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। তাঁর বায়োপিকে অভিনয়ের কথা ছিল ঋতুর।
সমাজ তাঁকে প্রান্তবাসী করলেও বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায় তাঁকে সাদরে ডেকে নিয়েছিলেন দু'টি ছবি 'প্রতিদ্বন্দ্বী' এবং 'সীমাবদ্ধ'তে। 'বহ্নিশিখা' (১৯৭৬), 'পেন্নাম কলকাতা' (১৯৯২)-র মতো ছবিতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। মিস শেফালি নেই---কথাটি শোনার পরে শোকের ছায়া সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায়ের গলাতেও। মুঠোফোনে জানালেন, ''১৯৭০ সালে 'প্রতিদ্বন্দ্বী', ১৯৭১-এ 'সীমাবদ্ধ'-য় কাজ করেছিলেন তখনকার প্রজন্মের হার্টথ্রব মিস শেফালি। প্রথম ছবিতে সেই যুগে সাহসী দৃশ্যে তাঁর সহজ অভিনয় একটু চোখে বেঁধেনি। সমাজ দূরে ঠেললে তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। প্রচণ্ড নিয়ম মেনে চলতেন। আমার ছবিতে তাঁকে নিয়ে কাজ করার কোনও সুযোগ হয়নি। তবে অনুষ্ঠানে দেখা হলে সৌজন্য বিনিময় হত।''
মিস শেফালির চলে যাওয়ার খবরে শোক জানিয়েছেন অরিন্দম শীলও, 'আমি ওঁকে কাছ থেকে দেখিনি। মিস শেফালিকে আমার দেখা পর্দায়, সত্যজিৎ রায়ের ছবি দিয়ে। কলকাতায় তাঁর মতো এমন সাহসী পদক্ষেপ সেই সময় কেন এখনও কোনও বাঙালিনী নিতে ভয় পান, দু'বার ভাবেন। মিস শেফালি সেই দিক থেকে ব্যতিক্রম। আজীবন ওঁকে ঘিরে বরাবরই মারাত্মক ক্রেজ, কৌতুহল সবার মনে। কলকাতায় ক্যাবারে কালচারের প্রথম প্রতিকৃৎ তিনিই। সেই জায়গা আর পূর্ণ হবে না।' এমন এক ব্যক্তিত্বের বায়োপিক বানাতে আগ্রহ হয়নি অরিন্দমের? প্রশ্ন করতেই পরিচালকের স্বীকারোক্তি, 'মিস শেফালির জীবন ভীষণ আকর্ষণীয়। পর্দায় ফুটিয়ে তোলার মতোই। ইচ্ছে আছে। তবে হবেই, কথা দেওয়ার মতো সময় আসেনি এখনও।' ছবি হলে কাকে বাছবেন পরিচালক এই চরিত্রে? অরিন্দম জানালেন, 'ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে এই চরিত্রে ভালো মানাবে। ঋতু শেষের দিকে খুব কাছাকাছই ছিলেন মিস শেফালির। অসুস্থ অবস্থায় নানা ভাবে সাহায্য করেছেন তাঁকে। ফলে, পরিণত মিস শেফালির ভূমিকায় ঋতুপর্ণা বেশই মানানসই হবে। একেবারে অল্পবয়সে হয়ত অন্য কাউকে ভাবতে হতে পারে। আপশোস সেই ছবি, তাঁকে নিয়ে করা সেই কাজ দেখার জন্য থাকবেন না মিস শেফালি।'
মিস শেফালির মৃত্যুতে টুইটে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়:
টুইটে শোক জানান ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তও:
মিস শেফালির বায়োপিকে তাঁর অভিনয় করার কথা ছিল, জানান অভিনেত্রী। এবং শেষ জীবনে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিলোত্তমার প্রথম নতর্কীকে। 'একটা সময় যাঁকে সামনে থেকে দেখার জন্য, একটু ছোঁয়া পেতে পাগল হল সাতের কলকাতা, তখনকার তথাকথিত বিশিষ্টরা। তাঁর শেষ জীবন সত্যিই কষ্টের। অর্থাভাবে ভালো করে চিকিৎসাও হয়নি তাঁর। সংসারের মুখের দিকে তাকিয়ে কোনও নিন্দা, কোনও অপবাদ গায়ে মাখেননি আমার শেফালিদি। সত্যিই লার্জার দ্যান লাইফ তিনি। তাঁকে অবশ্যই বড় পর্দায় তুলে ধরা হবে। খুব ভালো স্মৃতি রয়ে গেল আমার সঙ্গে দিদির। মানুষে হিসেবে অতুলনীয়। খুব শিগগিরিই তাঁকে নিয়ে কাজ শুরু হবে', জানিয়েছেন ঋতু।
বড় পর্দার পাশাপাশি একাধিক নাটকেও দেখা গেছে মিস শেফালিকে। সেখানেও নাচের ঝড় তুলেছেন তিনি। কথিত আছে, একটা সময় সুপ্রিয়া দেবীকে নিয়ে নাকি প্রায়ই তাঁর নাচ দেখতে গ্র্যান্ড হোটেলে যেতেন উত্তমকুমার। একবার মহানায়ককে হোটেলের মঞ্চে তুলে নাচের সঙ্গী করেছিলেন মিস শেফালি। তাঁর বায়োপিক বানাতে পারেন কঙ্কনা সেনশর্মাও। বছর খানের আগে শোনা গেছে এমন খবরও।