স্মৃতিতীর্থ, ধর্মশাস্ত্রাচার্য এবং রাজবাড়ির প্রধান পুরোহিত জয়ন্ত কুশারী
কলকাতা: সর্বভারতীয় প্রাচ্য বিদ্যা অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। প্রাচ্য বিদ্যা অর্থাৎ, বেদ-বেদান্ত, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, বৈদিক গণিত, সংস্কৃত ব্যাকরণ, উচ্চারণ---এই নিয়ে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে প্রশিক্ষণের আয়োজন করে চলেছে এই প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে সংস্কৃত ভাষা যে দেব ভাষা নয়, লোক ভাষা সেটিও প্রচার করা এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য। দিল্লি সহ সারা দেশে এই প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের মাধ্যমে সাড়া জাগিয়েছিলেন শুরু থেকেই। এরপরেই কিছু বুদ্ধিজীবী অনুরোধ জানান, বাংলার সেরা উৎসব দুর্গাপুজো যে আন্তরিকতার বদলে আড়ম্বরে পরিণত হয়েছে। তাঁদের মতে, দুর্গাপুজোর দুটি অংশ পূজা এবং উৎসবের মধ্যে দুর্গোৎসব এই মুহূর্তে শুধুই উৎসব। পুজো হচ্ছে নমো নমো করে। এবং শাস্ত্রকে জলাঞ্জলি দিয়ে হচ্ছে। তাঁদের সেই অনুরোধ শুনেই প্রতিষ্ঠান শুরু করে পুরোহিত প্রশিক্ষণ কর্মশালার। প্রথম এই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয় শোভাবাজার রাজবাড়িতে। পরে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি সহ কলকাতার একাধিক রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ফের এই প্রশিক্ষণ স্থান ফিরে এসেছে শোভাবাজার রাজবাড়িতেই। ৪ সেপ্টেম্বর, বুধবার পুরোহিত প্রশিক্ষণ শিবিরের উদ্বোধন হয়। সেখানেই মুখোমুখি হন স্মৃতিতীর্থ, ধর্মশাস্ত্রাচার্য এবং সর্বভারতীয় প্রাচ্য বিদ্যা অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ জয়ন্ত কুশারী (Jayanta Kushari)। তাঁর কাছে প্রথম প্রশ্নই ছিল বিজ্ঞানের যুগে দাঁড়িয়ে কতজন এই প্রশিক্ষণে (Prist Workshop) আগ্রহী?
Durga Puja 2019: কলকাতায় এবার বহু পুজোর থিম ‘সবুজ'
জয়ন্ত কুশারী জানালেন, 'প্রথম শিবিরেই এই সংখ্যা প্রায় ১০০ ছুঁইছুঁই ছিল। জায়গার অভাবে মাত্র ৩০-৪০ জনকে আমরা সেবার নিতে পেরেছিলাম। আস্তে আস্তে এই সংখ্যা বেড়েছে আরও। কী শেখানো হয় এই প্রশিক্ষণে? রাজপুরোহিতের কথায়, কীভাবে হাত-মুখ পরিষ্কার করে পুজোয় বসতে হয় সেখান থেকে শুরু করি আমরা। শাস্ত্র, সংস্কৃত ভাষা, ব্যাকরণ, পুজো পদ্ধতি, উচ্চারণের পাশাপাশি কীভাবে সংকল্প করতে হয় সেটাও সেখানো হয় এখানে। যেমন, কারোর বাবা অসুস্থ। তিনি বাবার নামে সংকল্প করে দুর্গাপুজো করবেন বলে ঠিক করেছেন। তাঁর সংকল্প পদ্ধতি হবে একরকম। আবার কেউ হয়ত চাকরি পেয়ে পুজো দিচ্ছেন মায়ের। তাঁর সংকল্প কিন্তু আলাদা। এছাড়া, অনেকেরই মন্ত্রোচ্চারণ শুদ্ধ নয়। ত্রুটিপূর্ণ। সেই উচ্চারণও সংশোধন করি আমরা। শোভাবাজার রাজবাড়িতে এভাবেই মায়ের মূর্তি গড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিত গড়ি আমরা।'
কারা আসেন এই প্রশিক্ষণ নিতে? 'রাজ্যের নানা অঞ্চল থেকে নানা বয়সের পুরোহিত এবং যাঁরা এই পেশা নিতে ইচ্ছুক তাঁরা তো আসেনই। তার সঙ্গে থাকেন যজমান এবং পুজো কমিটির সদস্যরা। যাতে তাঁরা পুুজোর প্রকৃত কারণ, পুজোর সঠিক বিধি, আচার-আয়োজন সম্পর্কে জানতে পারেন। পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও এখানে অংশ নেন', জানান তিনি।
Durga Puja 2019: একটি বছর পরে মেয়ে আসছে ঘরে
অর্থাৎ, এই প্রশিক্ষণ শিবির মহিলাদেরও এই পেশায় আসতে উৎসাহী করছে? 'স্মৃতিতীর্থ জয়ন্ত কুশারী জানালেন, আমাদের দেশে এই প্রথা আর্যসমাজ থেকে চলে আসছে। অপালা, গার্গী, লীলাবতী, মৈত্রেয়ী, খনা---এঁরা কিন্তু ঋষিদের সঙ্গে বসে যজ্ঞ করতেন, পুরোহিত করতেন। তাই আমাদের প্রশিক্ষণ শিবিরে মহিলাদের সাদরে বরণ করে নেওয়া হয়। পুজোর পদ্ধতি শেখানো হয়। বাড়ির পুজো, নিজেদের পুজো যাতে সঠিক নিয়মে করতে পারেন।'
আর বায়োরারি পুজোয়? সেখানে মেয়েদের স্থান নেই? সেখানে কি এখনও পুরুষতন্ত্রই চলছে? এই প্রশ্নের উত্তরে জয়ন্ত কুশারীর ব্যাখ্যা, 'যাঁদের নাম বললাম, তাঁরা শুধুই নিজেদের পুজো করে এসেছেন। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে পুজো করতেন না। ফলে, আমরাও শাস্ত্রের উর্ধ্বে উঠে কোনও নিয়ম চালু করতে পারি না। তাছাড়া, মেয়েরা মায়ের জাত। দেবাদিদেব মহাদেব থেকে ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস---নারীকে মাতৃজ্ঞানে পুজো করে এসেছেন। যাঁরা পূজিতা কেন তাঁরা তাঁদের আসন ছেড়ে নেমে আসবেন! তাছাড়া, কিছু শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি পুরুষদের মতো নারীরা নাভিমূল থেকে ওঁম ধ্বনি দিতে পারেন না। এটাও কিন্তু অন্তরায়ের কারণ। আর প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় আমরা প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিই, এখান থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়ার পরে বাইরে কোনও মহিলা পুরোহিতের কাজ করতে পারবেন না।'
Durga Puja 2019: ‘গঙ্গা' আসছেন বাঘাযতীন তরুণ সংঘে, খুঁটিপুজোয় প্রিয়াঙ্কা
শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেব নারীর এই রজশঃলা হওয়াকে যদি শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া বলে আখ্যা দিতে পারেন তাহলে পুরোহিত সমাজের সমস্যা কোথা? প্রশিক্ষণ নিয়ে যদি কোনও মহিলা পুরোহিত বারোয়ারিতে পুজো করেন, পুরোহিত সমাজ বারণ করবেন, না প্রতিবাদ জানাবেন? অধ্যক্ষ জয়ন্ত কুশারীর উত্তর, 'কেউ কেউ কথার খেলাপ করেছেন বইকি। তবে আমাদের শাস্ত্র বলে, যাঁরা বিরুদ্ধে যাবেন তাঁদের আগে সুযোগ দেওয়া উচিত। তাই আজও আমরা মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিই। এবং শাস্ত্র মেনেই আমরা মহিলাদের পৌরোহিত্যের প্রতিবাদ করি না, আবার পাশেও থাকি না।'
Click for more
trending news