২০১৩'র নভেম্বরের পর যেন সবটা বদলে গেল! ইস্কুলকাট মেরে বেরিয়ে আসা দুপুরগুলো আর দাঁড়াল না, রাস্তার ধারের কোনও বাড়ি বা দোকানের সামনে, যেখানে কালার টিভিতে চলছে স্টার স্পোর্টস বা ইএসপিএন। প্রেমিক তার প্রেমিকাকে দেওয়া চিঠিটি সুমনের গান দিয়ে শুরু করে শেষে আর লিখল না ‘আমি তোকে কেমনভাবে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাই জানিস? ঠিক আটানব্বই সালের শারজার ১৪৫-এর মরুঝড়টির মতো করে'। পরিবারের যে নতুন বউটি কখনও তার স্বামীকেও বলতে পারেনি যে, আসলে তার ভালোবাসাটি বচ্চন বা শাহরুখ নয়, নয় পুরনো পাড়ার কানঢাকা চুলের রগচটা দাদাটিও, যাকে সে ভালোবাসে তিনি টিভিতে উদয় হলে কাউকে না জানিয়ে বাড়ির সকলের সঙ্গে টিভির দিকে খুব গোপনে লক্ষ রাখত সেও- রান্নাঘরের দরজা থেকে উঁকি দিয়ে, আর মনে মনে অতি ধুকপুকানি নিয়ে বলত- শ্বশুর আগেরদিন খেতে বসে রান্নায় নুন হওয়া নিয়ে যা-ই বলুক, আজ না হয় একটু বেশি হলুদ মিশে যাক, বকা সহ্য করে নেব, ওকে আউট করো না- সেও আর বলে না কিছুই।
রক্তের ভিতর কর্কটকে সঙ্গী করে যে মেয়েটির কেমো নিতে যাওয়ার কথা ছিল পরদিন, সে আগের রাতে বইয়ের পাতার ভিতর থেকে অতি প্রিয় ছবিটি বের করে বিড়বিড় করে বলেছিল- খুব ভয় লাগছে, একবার দেখো তোমার মতোই যেন ক্রিজে টিকে থাকতে পারি। একটা-দুটো কভার ড্রাইভও যেন মারতে পারি স্ট্রেট ব্যাটে। আউট যেন না হই… সেই মেয়েটিও মরে গেল কবেই।
কলেজের টেস্টে অকৃতকার্য হয়ে ফাইনাল পরীক্ষায় বসতে না পারা মানুষটি এবং বাইশ দিন আগে চাকরি চলে যাওয়া দুই বাচ্চার বাবা- কেউই বাড়িতে জানাতে পারেনি আসল ঘটনাটি। তাঁরা প্রতিদিনই কলেজে যাওয়ার নাম করে বেরোয়, অফিস যাওয়ার নাম করে বেরোয়। তারপর একদিন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দুজনেই তিনঘন্টা ধরে দেখল একটি ইনিংস। দুজনেই মনে মনে বলছিল, সেঞ্চুরিটা হয়ে যাক। বাড়িতে সত্যিটা বলে দেব। আর কিছু লুকোব না… তাদেরও দেখা হয় না আর, পাশাপাশি দাঁড়ানোও হয় না আর বহুদিন…
কেবল যে ছেলেটি হেরোইন নিতে নিতে নিতে ভুলে গিয়েছিল সব, হারিয়ে ফেলল তার প্রায় সমস্ত স্মৃতি, মারা গেল তার মা আর বউও ছেড়ে চলে গেল, সে আট মাসের ওপর রিহ্যাবে কাটানোর পর যেদিন টানা চব্বিশ ঘন্টা একটি ফাঁকা ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকার শাস্তি পেয়েছিল, সেদিন জানলা দিয়ে দেওয়ালে এসে পড়া অল্প আলোতেই লাইভ দেখে ফেলেছিল একের পর ম্যাচের। বহু পুরনো সেইসব ম্যাচ। যা কেনল ইউ টিউবেই পাওয়া যায় এখন। সে দেখেছিল দেওয়ালে এসে পড়া ওই আলোর মধ্যে দিয়ে। কোনওটা ইডেন, কোনওটা ওয়াংখেড়ে, কোনওটা লর্ডস, কোনওটা মেলবোর্ন, কোনওটা চিন্নাস্বামী, কোনওটা শারজা, কোনওটা বা কলম্বোর প্রেমদাসা স্টেডিয়ামে মুরলীধরনকে মারা লেটকাট… নেশাগ্রস্ত, সব হারিয়ে ফেলা ছেলেটির হয়ে ওইদিন ওই দেওয়ালেই এমআরএফ'টা নিয়ে ব্যাট করে চলেছিলেন তিনি…
যারা বলতে পারে না, যারা চেঁচাতে পারে না, প্রায় গোটা একটা জীবন পেরিয়ে গিয়েও একটা আন্দোলন বা মিছিল করা হয়ে ওঠেনি যাদের… ভলভো বাসের ভয়ে রাস্তা পেরোতে না পেরে প্রেমকে হারিয়ে ফেলা ভিতু, রোগা প্রেমিক…দিনের পর দিন বাসে ট্রেনে মেট্রোতে পুরুষাঙ্গের আরও জোরে চাপকে পিছনে নিয়ে লজ্জায় ঘেন্নায় ঠোঁট চিপে কলেজে যাওয়া মফসসলের মেয়েটি…কালো আর দাঁতউঁচু বলে ইস্কুলের বন্ধুরা ভয়াবহভাবে খেপানোয় আত্মহত্যা করতে চলা ক্লাস নাইনের ছেলেটি…তাদের সঙ্গে, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই প্রতিটা স্টেপ আউটে, প্রতিটা সেঞ্চুরির পর নতুন করে আকাশের দিকে তাকানোর মধ্যে দিয়ে সেই নব্বই দশক থেকেই আরেকটু বেশি করে নিজের পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির শরীরটা নিয়ে মিশে গিয়েছিলেন সচিন তেন্ডুলকর।
২০১৩ সালের নভেম্বরের পর দেশের হয়ে আর ব্যাট করতে আসেন না তিনি। কেবল তাঁর জন্মদিনটিই আসে। এখন টেনশন অনেক কম। প্রায় নেই বললেই চলে। তেমন একটি টেনশনহীন জন্মদিনের দুপুর তিনি উত্তর-পূর্ব ভারতের কোনও পাহাড়ঘেরা গ্রামে পাঁচরকম ভাজা দিয়ে পালন করুন, এমন একটি আবদার খুব ফিসফিস করে রইল তাঁর বহু ম্যাচ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দেখা এই সামান্য কলমচির পক্ষ থেকে।