হাইলাইটস
- শহুরে ভিড় থেকে একটু শান্তি চাইলে চলে যেতে হবে শান্তিনিকেতনে
- উৎসবের সময়গুলোতে মানুষের ঢল নামে শান্তিনেকতনের পথে
- উৎসবের সময় বাদ দিয়ে গেলে আসল শান্তিনিকেতনকে উপভোগ করা যায়
দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে অনেকগুলো দিন। শহুরে আস্ফালন থেকে দূরে যেতে চাইলে সবার আগে কোন জায়গার নাম মনে পড়ে বলুন তো? যেখানে একটু শান্তিতে, সংস্কৃতিতে, নিভৃতে সময় কাটানো যাবে। দু'দিন কাটিয়ে যখন ফিরবেন তখন মনের কোণায় শান্তি বিরাজ করবে। হ্যাঁ, একদম ঠিক ধরেছেন। আমি শান্তিনিকেতনের কথাই বলছি। অবশ্যই দোল বা অন্য কোনও উৎসবের সময় বাদ দিয়ে চেপে পড়ুন হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে যে কোনও ট্রেনে। চার ঘণ্টার মধ্যে সেই ট্রেন আপনাকে পৌঁছে দেবে রবি ঠাকুরের দেশে। রবি ঠাকুরের স্মৃতি, লাল মাটির দেশ, সোনাঝুরির জঙ্গল, সেই জঙ্গলে সারি দিয়ে বসে স্থানীয় মানুষদের হাট। কী কিনবেন? মন জুড়িয়ে যাবে সবেতেই। সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডে ঝুমুর, বাউল, কবিগানের সুর ভেসে এলে তো কথাই নেই।
চলুন তা হলে যাওয়া যাক শান্তিনিকেতনে। শিয়ালদহ থেকে যেতে হলে উত্তরবঙ্গগামী যে কোনও ট্রেনেই চেপে বসা যায়। আমি বেছে নিয়েছিলাম ভোরের কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। আমাকে যখন বোলপুরে নামাল ট্রেন ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গিয়েছে গোটা শহরের। এই স্টেশনে পা দিলেই মনটা কেমন ভালো হয়ে যায়। দূর থেকে ভেসে আসতে থাকে কখনও ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে...' এখানে পৌঁছতে অবশ্য কারও চাবি ভাঙার দরকার নেই। স্টেশনের বাইরে বেরতেই ছেঁকে ধরবে রিকশা, টোটো। নিয়ে চলে যান হোটেলের সন্ধানে। কোনও উৎসবের সময় না হলে সহজেই পকেট অনুকূল ঘরও পেয়ে যাবেন।
আমরা কিন্তু বেছে নিয়েছিলাম বোলপুর স্টেশনের রিটায়ারিং রুম। সেটা অবশ্য নিজেদের সুবিধের কথা ভেবেই। কারণ ফেরার দিন কাকভোরে ট্রেন যাতে কোনও ভাবে মিস না হয়ে যায়। ফেরার কথা এখনও অনেক দূর। আগে তো জমিয়ে শান্তিনিকেতনকে উপভোগ করি।
বরামাঙ্গওয়ার ঝুল বারান্দায় মেঘের সঙ্গে খেলা করে চাঁদের আলো
যত বার যাই ততবারই নতুন নতুন রূপে ধরা দেয় শান্তিনিকেতন। সারারাত প্রায় জেগে ভোরের ট্রেন ধরায় একটু বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। তাই ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে স্টেশনেরই ক্যান্টিনে বাটার টোস্ট আর অমলেট দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে একপ্রস্থ ঘুম। ঘণ্টা দুয়েকের ঘুমে শরীর একদম ঝরঝরে। দুপুরের সূর্য তখন মাথার উপর। তাই স্নান সেরে বেরিয়ে পড়া। স্টেশনের বাইরে থেকেই পেয়ে গেলাম একটা গাড়ি। এ বার শুধু ঘুরে বেড়ানো।
শুরু বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে। যেখানে ঢুকলে কোথা দিয়ে যে সময় কেটে যায় বোঝাই যায় না। এ গলি, সে গলি, এ বাড়ি, ও বাড়ির আনাচ-কানাচ দিয়ে শুধু উঁকি দিয়ে যায় ভাল লাগা। আর তখন যদি সাইকেলে চেপে আপনার সামনে এসে দাঁড়ায় ভাড়ে করে দই আর রাবড়ি— তা হলে তো কথাই নেই! আমার সঙ্গীটি মুহূর্তের মধ্যে তিনটি ভাড় শেষ করে আরও একটির দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে। আমাকেই উদ্যোগ নিয়ে থামাতে হল।
ছায়াতালে ছুঁয়ে যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা-কাব্রুর ছায়া
সন্ধে নামার আগে সোনাঝুরিতে পৌঁছতে হবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মায়া ত্যাগ করতেই হল। গাড়ি ছুটল শহুরে পথ পেরিয়ে উঁচু-নিচু লালমাটির উপর দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা লম্বা গাছের জঙ্গলের দিকে। যখন সেখানে পৌঁছলাম, সূর্য তখন সবে তার দিনের শেষ আলো ছড়িয়ে পাটে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। গাছের ফাঁক দিয়ে সেই আলো ঠিকরে এসে পড়ছে লাল মাটিতে। অদ্ভুত মায়াবী এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
থমকে যেতে হল মূহূর্তে। ‘‘শুনতে পাচ্ছ গানটা? কোথা থেকে আসছে বলতো?''
‘‘ওই তো ও দিক থেকে।''
‘‘চল যাবে?''
‘‘অবশ্যই।''
সত্যিই বেশি দূর যেতে হল না। দেখা হয়ে গেল সেই বাউলের সঙ্গে। এক মনে যিনি গেয়ে চলেছেন একের পর এক গান— ‘...কলঙ্কিনী রাধা... কদম ডালে বসিয়া আছে কানু হারামজাদা...' এতটাই মনোমুগ্ধকর যে তা ছেড়ে যাওয়া দায়। অদ্ভুত এক বন্ধনে বেঁধে ফেলে বার বার। কিন্তু একটা সময় মায়া ত্যাগ করতেই হল। টুকটাক কেনাকাটা। তার পর ফেরার পথে একবার উঁকি দিয়ে দেখে নেওয়া সেই ‘আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে'। কোপাইয়ের পারে সন্ধে পেরিয়ে রাত হল অদ্ভুত মায়া মাখা মুখ নিয়ে। ফেরার পথ তো ধরতেই হবে। সেই বোলপুর স্টেশনের ঘরে।
পর দিনটাও যদি থেকে যান, শুধুই ঘুরে-বেড়ান বিশ্বভারতীর আনাচ-কানাচ। দেখা হয়ে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। গলা ছেড়ে গান ধরুন। কেউ ব্যাঙ্গ করার নেই। সঙ্গীর হাত ধরেই চলুন বা পরিবারের সকলকে নিয়ে। এই জায়গা সবার। প্রাণের, মনের, ভালবাসার।
Click for more
trending news