কলকাতা: বাঙালি আর যাই হোক সাহসী জাতি নয়, অথবা সাহস ছিল বহুকাল আগে, তা বন্ধক দিয়ে আমরা এখন নিজস্ব সুখী কর্পোরেট গৃহকোণে মগ্ন। আমাদের শীতঘুম বড় প্রিয়, আমাদের পাশ ঘেঁষে গুলি চলে গেলে আমরা পাশ বদলে আয়েশ করি, মানুষের রক্ত দেখলে আমাদের বড়জোর ঘাম হয়। তারপর এসির হাওয়া চালিয়ে অবশ্য সেসব ঘাম আর চিন্তা দুই শুকিয়ে ফেলি। আমাদের শিক্ষা নিয়ে মাথাব্যথা কম, ধর্ম নিয়ে উন্মাদনা আমাদের চিরকালই পাশের বাড়ির সমস্যা বলে মনে হয়। ধর্ম হোক বা আত্মবোধ আমাদের কোনও কিছুর গভীরে ভাবার অভ্যাস কম। অথচ অবাক না হয়ে উপায় নেই, যে ধর্মান্ধতা নিয়ে আজ এত আলোচনা, লোকসভা নির্বাচনের ৮৫ দিন কাউন্টডাউন নিয়ে যতখানি উদগ্রীব আমরা সেসবের বহু উর্ধ্বে গিয়ে ১৫৭ বছর আগে এক মানুষ ধর্মের মূল কথা সহজেই তুলে ধরেছিলেন বিশ্বের কাছে। তাঁর শীতঘুম ছিল না, চেতনা ছিল। আজ সেই চেতনার জন্মদিন, স্বামী বিবেকানন্দের ১৫৭তম জন্মবার্ষিকী।
১৫৭ বছর সময়টা কম না। এতটা সময়ে জাতি বদলে যায়, রাষ্ট্রও। ক্ষমতা হস্তান্তর হয়, মানসিকতাও। সহনশীলতা ও সাহচর্যের কথা বলতে বলতে একদিন সেই মানুষই বিধর্মীর নাম দিয়ে পুড়িয়ে মারে মানুষকে, পুড়িয়ে মারার আনন্দ বন্দীও করে রাখে নিজস্ব ক্যামেরায়। পিছনে ফিরে দেখা যাক, ১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগোর ধর্ম মহাসম্মেলনে দাঁড়িয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বললেন, “আমি গর্বিত! কারণ আমি এমন এক ধর্মের মানুষ যা আমাদের বিশ্বকে সহনশীলতা আর গ্রহণশীলতা দুই'ই শিখিয়েছে। আমরা বিশ্ব শান্তিতেই বিশ্বাস করিনা, আমরা সকল ধর্মকেই সত্য বলে গ্রহণ করি।” (I am proud to belong to a religion which has taught the world both tolerance and universal acceptance. We believe not only in universal toleration, but we accept all religions as true.)
কাট টু ২০১৫, ২৮ সেপ্টেম্বর। বিবেকানন্দের সহনশীলতা আর গ্রহণশীলতার উত্তর দিয়েছে ভারতবর্ষ। উত্তরপ্রদেশের দাদরি গ্রামে গরুর মাংস খাওয়ার ‘অপরাধে' মহম্মদ আকলাখকে পিটিয়ে হত্যা করেছি আমরা।
কাট টু ২০১৭, ৭ ডিসেম্বর, মুসলিম হয়ে হিন্দু মেয়ের সঙ্গে প্রেমের ‘অপরাধে' পশ্চিমবঙ্গের মহম্মদ আফরাজুলকে পুড়িয়ে সেই পাশবিক হত্যাকাণ্ড নিজের ১১ বছরের শিশু ও ১৪ বছরের ভাইপোকে দিয়ে ভিডিও করিয়ে ‘লাভ জিহাদ' ঘোষণা করে ‘সকল ধর্মকে সত্য' বলে গ্রহণ করে দেখিয়েছে রাজস্থানের শম্ভুলাল।
বিবেকানন্দের চেতনা থেকে হোক বা শিকাগোর সম্মেলন থেকে- ধর্ম নেমে এসেছে পাঁকে। যে হিন্দুধর্মে গর্ব খুঁজে পেয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, যে ধর্ম দিয়ে মন জয় করেছিলেন আমারিকাবাসী ভাই ও বোনেদের- সেই ধর্মই এখন ব্যুমেরাং হয়ে ভারতীয় সংস্কৃতি ও রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হয়ে দেখা দিয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে এতকাল আগেও বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতা এবং তার ভয়ঙ্কর বংশধর ধর্মান্ধতা দীর্ঘকাল ধরে এই সুন্দর পৃথিবীকে হিংসায় ভরিয়ে তুলছে, মানুষের রক্তে ভরিয়ে তুলছে। সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।” (Sectarianism, bigotry, and its horrible descendant, fanaticism, have long possessed this beautiful earth. They have filled the earth with violence, drenched it often and often with human blood, destroyed civilization and sent whole nations to despair.)
অথচ আমরা কেবল গেরুয়া বসন স্বামীজীর জন্মদিনই পালন করেছি, শিখিনি কিছুই! সাম্প্রদায়িকতা বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ভোটঅস্ত্র। ধর্মবোধ আর ধর্মান্ধতাকে পৃথক করে শনাক্ত করতে চেয়েছিলেন স্বামীজী। আজ তাঁর জন্মদিন, বছর ঘুরে আবারও আসবে জন্মদিন। সংকীর্ণতা ছেড়ে আমাদের নয়া জন্ম হবে তো? আজ এই দিনে বরং প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠুক ধর্ম ও সহিষ্ণুতার চিরন্তন পাঠ।