ন্যাশনাল লাইব্রেরির পক্ষ থেকে ওই সময় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ওপর একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়
একটা নয়, দুটো নয়, একশো বা দুশোটাও নয়, সংগ্রহে রয়েছে মোট ৮৭,৫০০'টি বই। বিশ্বের মহানতম পাঠক এবং পুস্তকপ্রেমীদের নিয়ে কোনও আলোচনা হলে, সেই আলোচনায় তাঁর নাম উঠে আসতে বাধ্য। বই ছাড়া একটি মুহুর্তও কাটত না তাঁর। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই উনবিংশ শতক এবং বিংশ শতকের শুরুর দিকে তাঁর বই পড়ার জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থাও ছিল না। যা ছিল, তা হল সূর্যের আলো। তিনি যে বেশিরভাগ বই সেই সময়েই পড়তেন, তা খানিকটা আন্দাজই করা যায়। এত বই তো একটি ঘরে রাখা সম্ভব নয়। তাহলে তা কোথায় থাকত? বই রাখার জন্য কতগুলো আলমারি ছিল তাঁর কাছে? প্রশ্ন উঠে আসে মনে আপনা থেকেও বিদেশ থেকে আসা বইয়ের জন্য তিনি অপেক্ষা করছেন বা উপহার হিসেবে বন্ধুরা তাঁর হাতে বই তুলে দেবেন, তেমন এক মুহূর্তের জন্য তিনি অপেক্ষা করছেন... তাঁর সংগ্রহের কথা মনে পড়লে এই দৃশ্যগুলিও পরপর ভেসে আসে চোখের সামনে। অজান্তেই। সত্যি বলতে, এই ব্যাপারগুলো অতি সুচারুভাবে না ঘটতে থাকলে একজনের সংগ্রহে ৮৭,৫০০'টি বই থাকতে পারে কী করে! ভাবতে বসলে বিস্মিত হতে হয় বই কী! যে মানুষটা এমন বিস্মিত করে তোলেন আমাদের, তাঁকে চেনে প্রতিটি বাঙালি। চেনা উচিত প্রতিটি ভারতীয়র। তাঁর নাম- আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। আলিপুরের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে কেবল তাঁর বইয়ের সংগ্রহ নিয়েই একটি নতুন লাইব্রেরি তৈরি করা হয়েছে। তাঁর বইয়ের এই বিপুল সংগ্রহকে যোগ্য সম্মান দিয়ে জাতীয় গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ সেগুলির অতি যত্ন সহকারে সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছেন।
ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে প্রবেশ করলে উপলব্ধি করা যায় এক নতুন বাতাস। এই বাতাসে মিশে আছে বইয়ের অমোঘ গন্ধটি। যে বাতাসে শ্বাস নিয়েছেন উনবিংশ শতক এবং বিংশ শতকের বহু প্রকৃত গ্রন্থপ্রেমী মানুষ। বই যে জীবনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠতে পারে, অস্যার্থে হয়ে উঠতে পারে একটি গোটা জীবনই, তেমনটা যে সেই সময়ের বহু মানুষ অত্যন্ত নিবিড়ভাবে ভেবেছিলেন, তার ছাপ রয়ে গিয়েছে আলিপুরের এই বিশাল বাড়িটির প্রতিটি কোণে। আমি ঠিক জানি না, ওই সময়ের পুস্তকপ্রেমীদের সংগ্রহ এবং তাঁদের জীবনে একটি বইয়ের ভূমিকা কী ছিল, তা নিয়ে আলাদা করে কোনও গবেষণা হয়েছে কি না, বা, বই রয়েছে কি না। তবে, এটুকু মনে হয় যে, কীভাবে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সংগ্রহে অত বিপুল বই এল এবং তিনি ছাড়াও ওই সময়টার কোন কোন মানুষের কাছে ছিল এমন বা এর কাছাকাছি বইয়ের সংগ্রহ, তা জানা প্রয়োজন। প্রয়োজন তা নিয়ে কথা বলার। তা নিয়ে গবেষণার।
ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে সবথেকে পুরনো যে বইটি রয়েছে, তা ১৫২৫ সালের। অর্থাৎ, আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে প্রকাশিত একটি বই। আমি বহু ভাষার অভিধান দেখেছি। কিছু রঙিন এবং থ্রিডি'তে ছাপানো বই তো অসম্ভব অবাক করে দেওয়ার মতো। ওই বইগুলির মধ্যে একটি বই থেকে পাওয়া একটি ছবির কথা বলি। ছবিটি একটি ভারতীয় সাপের। সাপটি বিষধর। ফণা তুলে আছে। এমন নিপুণভাবে সেই সাপটিকে থ্রিডি'তে আঁকা হয়েছে, যে কেউ আচমকা দেখলে মনে করতে পারে, বইয়ের ওপর স্বয়ং এসে বসেছেন নাগ দেবতা। একটা বই দেখলাম, যার গায়ে লেখা ছিল- হিন্দুত্ব। লেখকের নাম- রামদাস গৌড়। এই বইটি তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে দিয়েছিলেন। বইটি একটু উলটেপালটে দেখছিলাম। সেখানে বহু কর্মকাণ্ডের নিয়মাবলী লেখা রয়েছে। আশুতোষের সংগ্রহে একই বইয়ের একাধিক সংস্করণ রয়েছে বহু। আরব্য রজনীর ৩০'টি সংস্করণ রয়েছে। সংগ্রহে যে কত বিভিন্ন বিষয়ের বই রয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই! আইনের বইয়ের সংখ্যা তার মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশি। এছাড়া, জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, ভৌতবিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, অর্থশাস্ত্র, ফাইন আর্ট- তালিকা দীর্ঘ।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের গণিত নিয়ে ভালোবাসা এবং দুর্দান্ত প্যাশনের কথা কারও অজানা নয়। তা নিয়ে বহু কাহিনিও ভেসে বেড়ায় বাংলার ঘরে ঘরে। ১৮৮১ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ে প্রকাশিত তাঁর গবেষণাপত্রটি এখনও বহু গণিতজ্ঞের কাছে রীতিমতো আলোচনার বিষয়। গণিতের প্রতি ওঁর প্যাশন ঠিক কেমন ছিল, তা একটা ছোট উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। জার্মান আর ফ্রেঞ্চ গণিতজ্ঞদের খ্যাতি উনবিংশ শতাব্দীতে ছিল গোটা বিশ্বজুড়ে। ওই দুই ভাষার গণিতজ্ঞদের কাজগুলো পড়বেন বলে তিনি দুটো ভাষাই শিখে নেন নিজের চেষ্টায়। ভালোবাসা ছিল আইন নিয়েও। ১৮৮৭ সালে আইনের ডিগ্রি নিয়ে ওকালতি শুরু করে দেন। প্রথমে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হন। তারপর ১৯২০ সালে কয়েকদিনের জন্য প্রধান বিচারপতির পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম সেরা বিচারপতি হিসেবে বারেবারে উঠে আসে তাঁর নাম।
একজন মানুষের দুনিয়াটা ঠিক কতবড়, তা বোঝা যায়, তাঁর জ্ঞানের ব্যাপ্তি দেখে। বই পড়ার সঙ্গে জ্ঞানের সরাসরি সম্পর্ক হয়তো পুরোটা নেই, তবে, কিছুটা তো আছে। সেটুকু মেনেই বলা যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দুনিয়াটা যে কী বিশাল ছিল, তা তাঁর বইয়ের সংগ্রহ দেখলেই হাড়ে হাড়ে মালুম হয়। এর আগে তো বেশ কিছু বিষয়ের নাম বললামই। সেগুলি ছাড়াও রয়েছে সংস্কৃত, ইংরেজি, দর্শন শাস্ত্র, সমাজবিজ্ঞান... সর্বত্র তাঁর জ্ঞানের প্রবল ব্যাপ্তি।
২০১৪ সালে তাঁর সার্ধশতবর্ষ পালন করা হয়েছিল। ন্যাশনাল লাইব্রেরির পক্ষ থেকে ওই সময় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ওপর একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। ১৯২৪ সালে প্রয়াণ হয় তাঁর। তার আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন করেছিলেন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও যে 'ছাত্রবৎসল' হতে পারেন, সেই ধারণা মানুষের মনে প্রোথিত করার ব্যাপারে আশুতোষের অবদান নিঃসন্দেহ স্মরণ করার মতোই। অনেক চেনা ছাঁদকে ভেঙে দিতে পেরেছিলেন তিনি। তৈরি করেছিলেন চিরনতুন এক ধারণাকে। যা গ্রহণীয় হয়েছিল সর্বত্র। মাত্র ২৫ বছর বয়সেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটের সদস্য হয়ে যান তিনি। ১৯০৬ সাল থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ১৯২১ সালে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন আশুতোষ। ১৯০৮ সালে স্থাপন করেন কলকাতা ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি। ন্যাশনাল লাইব্রেরি যখন ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি ছিল, সেইসময় বাংলার এই চিরকালীন বাঘ ছিলেন তার সদস্য।
তাঁর নামে কলকাতায় রাস্তা আছে। কলেজ আছে। মূর্তি আছে। কিন্তু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আসলে ওইসব জায়গায় নেই। তিনি রয়েছেন তাঁর সংগ্রহের মধ্যে। তিনি রয়েছেন বইয়ের মধ্যে। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে রাখা ৮৭,৫০০'টি বইতেই রয়ে গিয়েছে এই প্রবল পণ্ডিত মানুষটির আত্মার আলোটুকু।