কলকাতা: বাড়ি কোথায়?
-ওই দিকে…
যেদিকে দেখাল ছেলেটি সেদিকে আর যাই হোক কারও বাড়ি হতে পারে না। সাত নম্বর প্ল্যাটফর্মের এক কোনায় একটা ছেঁড়া ত্রিপল পড়ে আছে। সম্ভবত ওটাই ওর বাড়ি ...বাসা... ভিটেমাটি।
নাম কী?
-কিষ্ণ।
আর তোর ভাইয়ের নাম?
-মুজাহির।
স্টেশনে এসে সব গুলিয়ে যায়। কাকে বলে সাকিন, কাকে বলে জাত, কাকে বলে বেড়ে ওঠা, কাকেই বা বলে জন্ম-মৃত্যু। এও এক দেশ। ভারতের মধ্যে অন্য এক ভারত। এক একটা প্লাটফর্ম যেখানে নিজেরাই হয়ে ওঠে এক একটা যাপন। এক একটা ট্রেন এক একটা জীবন। বাহাত্তর বছর আগে স্বাধীনতার ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছিল উপনিবেশের ছন্নছাড়া স্টেশনে। স্বাধীনতার ট্রেন আজও আসে, আজও যায়- শুধু যাওয়া আসা শুধু স্রোতে ভাসা জেনেই লাফ দিয়ে ট্রেনে ওঠে কিষণ, ঝুলতে ঝুলতে উঠে যায় ঠিক মুজাহিরও। মুজাহিরের বড় বড় কান, ঢোকা পেট, মুখ দিয়ে লালা গড়ালে বোঝে না। ঝাঁট দেয় ট্রেনে। সহ নাগরিকের এঁটো পরিষ্কার করে হাত পাতে। হাত পাতলে টাকাও আসে, মাথা পাতলে জ্ঞানও জুটে যায় আকছার। ‘ভিক্ষা করতে নেই, পড়তে হয়’, ‘ইস্কুলে যাস না কেন রে?’- এসব উচ্চারণ কানের ভিতর দিয়ে মরমে পৌঁছায় কি? তরঙ্গ তোলে কোনও? অত কথা মুজাহির বোঝে না, সে লালা মোছে না, হাত পাতে; শীতে জামা গায়ে দেয় না- তাতে দয়ার রোজগার বাড়ে।
অলিখিত নিয়ম চলে এই দেশে, দেশ বলতে আমরা যাকে বলি প্লাটফর্ম। একদম কুচো হলে ভিক্ষা। মানুষের কাছে কচি মুখের ফটোগ্রাফিক কদর ভালো। আর সেরা ক্যামেরা মানেই তো নয়ন যুগল। তাই ভিক্ষারত বাচ্চা চোখে পড়লেই উদার হয়ে যায় আপামর সহ নাগরিক। খুঁটে খাওয়া শুরু হলেই ঝাঁটা- এই ট্রেন থেকে ওই ট্রেন, এই কামরা থেকে ওই কামরা- ভারতের স্বচ্ছতার দিকে এক কদম এগিয়ে যায় শৈশব। আরেকটু বড় হলে, মানে বাচ্চা মুখের ফটোগ্রাফিক কদর কমে গেলে রোজগারে নামতে হয়। বয়স বারো কি তেরো রিকশা চালাচ্ছে- রিকশা চালাতে গেলে ভিনদেশে যেতে হয়। ভিনদেশ মানে প্ল্যাটফর্মের বাইরের দুনিয়া। দেশের মধ্যে খেটে খেতে হলে পেপার সোপ বিক্রি। তারও বেশি বড় হলে জলের বোতল বিক্রি। গড়পড়তা প্ল্যাটফর্ম শৈশবের উত্থানও এই, পতনও এইভাবেই।
কিষণের তবু পেট ভরে না। ঝাঁটা দিয়ে কখনও 200, কখনও 50। মহাজনের কাছে রোজের হিসেবে জমা রাখতে হয় 100। মহাজনের নাম ‘মা’। দেশ মা, গর্ভধারিণী মা, সকলের কাছেই ঋণী কিষণ। কীসের ঋণ তা যদিও জানা নেই। সে শুধু জানে মায়ের হাতে ভিক্ষা করে নিত্য তুলে দিতেই হবে 100 টাকা। বাবা লাট হয়ে পড়ে রইলে তাঁকেও 50 টাকা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এসবের পরে যদি বাঁচে কিছু, কিষাণ 10 টাকার কেক কিনে খায়। বাকি খুচরো জমিয়ে রাখে স্বপ্নের মতো। মুজাহির তার ভাই কিনা সে জানে না, আদৌ তাঁর নাম কিষণ কিনা তাও জানে না। নামকরণের স্বাধীনতা কোনও শিশুরই থাকে না। যাকে মা বলে জানে বা যাকে বাবা- সেখানেও প্রশ্ন থেকে যায় নিয়ত। ঝগড়া হয়, খিস্তি খেউড়ে তন্দ্রা কাটে, মাঝে মাঝে উড়তে থাকা ডেনড্রাইটের কাগজ আবেশ ছড়িয়ে যায়। দু’ একবার নেশা করেও দেখেছে- নেশা করলে খিদে পায় না। কুলিদের লাথিও আরামের মনে হয়, চিন্তা কমে যায়। নিজের বাপ মাকে মন খুলে গালি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়া যায়। ঘোর কাটে আস্তে আস্তে, স্বাধীনতার ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে চলে আসে উপার্জনের ফ্ল্যাগ নাড়িয়ে।
লাওয়ারিশ একটা ছেঁড়া ঘুড়ি আছে কিষণের, এখন যদিও তারই ওয়ারিশ সে। সুতোটুকু ছোট্ট, ওই ডেনড্রাইট দিয়েই তাপ্পির কাগজে জুড়ে যায় ঘড়ি, কিন্তু ওড়ে না। লাটাই নেই। এক্সপ্রেস টেনে সাফাই করে যতটুকু হয় মায়ের ‘নিরাপদ’ হাতে দেওয়ার পর যেটুকু থাকে কেকই হয়, কেক না খেয়ে লাটাই কেনার বিলাসিতা কিষণের মাথায় আসে না মনেও না। কম রোজগারের সাথে চড় থাপ্পড় যা জোটে- পেটে খেলে তবেই না সইবে পিঠে?
সাকুল্যে 72 টাকা জুটেছে আজ। কম্পিটিশন বেড়ে গেছে দেশে, দেশ বলতে এক থেকে সাত নম্বর প্ল্যাটফর্ম। কাল 15 তারিখ। 14 তারিখ বাড়ি ফিরবেন সহ নাগরিকেরা। উপার্জন বাড়ে বলে দেওয়ালি, পুজো, 26 জানুয়ারির এইসব দিনের আলাদাই ইজ্জত তাঁর ব্যক্তিগত ক্যালেন্ডারে। কিন্তু কম্পিটিশন- 72 টাকা বেরিয়েছে পকেট ঝেড়েঝুড়ে। এঁদের অঙ্ক শিক্ষক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। ফলত শেষ ট্রেনের বাথরুম লাগোয়া খোলা দরজায় পা ঝুলিয়ে বসে হাত গুণে কিষণ বুঝে যায় 28 টাকা কম আছে। বুঝে যায় মায়ের বিকৃত মুখ আর ঝাঁঝালো গলা। টের পায় পিঠে আঁচড় আর জন্মদাত্রীর (?) খিস্তি.... হাওয়ায় চিটচিটে চুলও ওড়ে। বাড়ি ফিরছেন যাত্রীরা। স্বাধীন দেশের সহনাগরিকেরা ভিটেয় ফিরছেন নিশ্চিন্তে। প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে সামান্য থেমে যায় প্রাক-স্বাধীনতার ট্রেন। আর একটু পরেই তাঁর দেশে ঢুকে পড়বে ট্রেন। লাটাই কিনবে আজ কিষাণ। যাকে ভাই বলে জানে সেই মুজাহিরকেও কিনে দেবে। তারপর ঘুড়ি ওড়াবে অন্য দেশে...সহনাগরিকদের মাথার উপর দিয়ে। বাহাত্তর অনেক বড় অঙ্ক... 72 বছরে দেশ তেমন পালটায় না। তবে বাহাত্তর টাকায় কিসমত পালটায় আজও।
মুজাহিরের হাত ধরে অন্ধকারে নেমে যায় সে। নিজস্ব দেশের আগে ঝুপুস অন্ধকারে নেমে যায় দুই জনে। দেশকে পিছনে রেখে অন্ধকারে এগোয়...
Click for more
trending news